রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক প্রবন্ধে লিখছেন, “সম্প্রতি হিন্দুর প্রতি আড়ি করিয়া বাংলাদেশের কয়েকজন মুসলমান বাঙালি-মুসলমানের মাতৃভাষা কাড়িয়া লইতে উদ্যত হইয়াছেন। এ যেন ভায়ের প্রতি রাগ করিয়া মাতাকে তাড়াইয়া দিবার প্রস্তাব। বাংলাদেশের শতকরা নিরানব্বইয়ের অধিক-সংখ্যক মুসলমানের ভাষা বাংলা। সেই ভাষাটাকে কোণঠেসা করিয়া তাহাদের উপর যদি উর্দু চাপানো হয়, তাহা হইলে তাহাদের জিহ্বার আধখানা কাটিয়া দেওয়ার মতো হইবে না কি। চীনদেশে মুসলমানের সংখ্যা অল্প নহে, সেখানে আজ পর্যন্ত এমন অদ্ভুত কথা কেহ বলে না যে, চীনাভাষা ত্যাগ না করিলে তাহাদের মুসলমানির খর্বতা ঘটিবে। বস্তুতই খর্বতা ঘটে যদি জবরদস্তির দ্বারা তাহাদিগকে ফার্সি শেখাইবার আইন করা হয়। বাংলা যদি বাঙালি-মুসলমানের মাতৃভাষা হয়, তবে সেই ভাষার মধ্য দিয়াই তাহাদের মুসলমানিও সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ হইতে পারে।“
কবিগুরুর প্রবন্ধের এই সামান্য অংশেই প্রতীয়মান হয় যে তৎকালীন বাংলাদেশে (অবিভক্ত) বাঙালী মুসলমানদের উপর উর্দু চাপিয়ে দেবার একটি প্রচেষ্টা প্রবল হয়ে উঠেছিল।
১৯৪০ সালের ৩১ মার্চ এ অপচেষ্টার প্রথম প্রকাশ ঘটে কোলকাতায় মুসলিম ইন্সটিউট হলে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পরিষদ আয়োজিত ইকবাল দিবসের অনুষ্ঠানে। আয়োজনের সভাপতি আব্দুর রহমান সিদ্দিকী বাংলায় বক্তৃতা করার বিরোধিতা ক’রে কিছু কটু বাক্য ব্যবহার করেন ‘বাংলা’ ও যারা অনুষ্ঠানে বাংলায় ভাষণ দিতে চান তাদের আক্রমণ ক’রে। এর ফলে উপস্থিত ছাত্র-যুবকেরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এক সময়ে উপস্থিত বক্তা ও শ্রোতার বিরোধীতার মুখে আব্দুর রহমান সিদ্দিকীকে সভাস্থল ত্যাগ করতে হয় অনেকটা হেনস্তা হয়েই।
বিক্ষুব্ধ ছাত্র-যুবককে শান্ত করতে পরিষদের সম্পাদক হাবীবুল্লাহ বাহারকে বলতে হয়, “বঙ্গভাষা আজ বিশ্বে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়া আছে এবং বঙ্গভাষাই বাঙালী হিন্দু-মুসলমানের মাতৃভাষা। … সভায় বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করিতে দেওয়া হইবে না বলা এবং বাংলা ভাষাকে অপমান করা একই কথা। আমরা উর্দুকে শ্রদ্ধা করিব, কিন্তু মাতৃভাষার উপরে তাহাকে স্থান দিতে পারিব না।”
অবশ্য দুর্ভাগ্যজনক যে পরবর্তীকালে এই হাবীবুল্লাহ বাহার রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে উর্দুর পক্ষেই অবস্থান নেন।
এর কিছুদিন পরে আবারও রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দীন আহমদের বক্তব্যে। তিনি বলেছিলেন, “ভারতে যেমন হিন্দি রাষ্ট্রভাষা হতে যাচ্ছে, পাকিস্তানে তেমনই উর্দু রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত”।
সঙ্গে সঙ্গে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ জিয়াউদ্দীনের এই বক্তব্যের প্রতিবাদ ক’রে বলেন, “অধিকাংশ জনসংখ্যার ভাষা হিসেবে বাংলাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত, যদি দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা গ্রহণের প্রয়োজন হয় তখন উর্দুর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে”।
তমদ্দুন মজলিশ ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে? বাংলা নাকি উর্দু?” নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে যেখানে বাংলাকে পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করার দাবী করা হয় ।
দ্বিজাতিতত্ত্বের মত একটি ঐতিহাসিক ভুল মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে ১৯৪৭ সালের আগস্টে পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র তিনমাস পর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই সরকারী বিভিন্ন ফর্ম ও নতুন ছাপা টাকা, ডাকটিকেট, পোষ্টকার্ড, ট্রেন টিকেটে কেবলমাত্র উর্দু এবং ইংরেজি ব্যবহারে ক্ষোভের সঞ্চার হয় সরকারী কর্মচারীদের মাঝে। তারা প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠে। এদের সাথে এক পর্যায়ে যুক্ত হয় ছাত্র-শিক্ষকেরাও। তৎকালীন সচিবালয় থেকে এই বিক্ষোভ পলাশী ব্যারাক পর্যন্ত ব্যাপ্ত ছিল। সেদিনও স্বতস্ফুর্ত সমাবেশ এবং মিছিল হয়েছিল। তবে এই বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলে উত্থাপিত দাবি ছিল মুখ্যত সরকারী বিভিন্ন ফর্ম, সদ্য ছাপা টাকা, ডাকটিকেট, পোষ্টকার্ড, ট্রেন টিকেটে বাংলা লেখা সংযোজনের।
১৯৪৭ সালের ৫ ডিসেম্বরে শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানের তৎকালীন রাজধানী করাচীতে শিক্ষা সম্মেলনে সর্বপ্রথম উর্দুকে রাষ্টভাষা করার জন্য প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রতিবাদে ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশ আয়োজিত হয়। বক্তৃতা করেন মুনীর চৌধুরী, কল্যাণ দাশগুপ্ত, একেএম আহসান প্রমুখ আর সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আবুল কাসেম। সভায় বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ববঙ্গের (তখন পাকিস্তানের পূর্বাংশের নাম ছিল পূর্ববঙ্গ) প্রশাসনিক ও শিক্ষার বাহন হিসেবে গ্রহণের সুস্পস্ট দাবী উত্থাপিত হয়।
১৯৪৮ এর ২৩ ফেব্রুয়ারী রাজধানী করাচীতে পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারীর অধিবেশনে পূর্ববঙ্গের অন্যতম প্রতিনিধি কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসাবে যুক্ত করার প্রস্তাব করেন।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সেই প্রস্তাবনাতে বলেন – Out of six crores and ninty lakhs people inhabiting this state, 4 crores and 40 lakhs of people speak Bengali language. So, sir, what should be the State language of the state? The state language of the state should be the language which is used by the majority of the people of the state, and for that, sir, I consider that Bengali language is a lingua franca of our state.
গণপরিষদে বিলটিকে ‘হিন্দুয়ানী সংস্কৃতিকে পাকিস্তানের সংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশ’-এর চেষ্টা আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী বলেন, ‘পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করা এবং একটি সাধারণ ভাষার দ্বারা ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা থেকে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করাই এর উদ্দেশ্য’।
এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে পূর্ববাংলার তৎকালীন মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন বলেন, ‘পূর্ববাংলার অধিকাংশ অধিবাসীর মনোভাব হচ্ছে একমাত্র উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করা’।
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীসহ কয়েকজন এ প্রস্তাবের পক্ষে মত দিলেও বেশীর ভাগ বাঙালী সদস্যও এর বিরোধীতা করেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দমে না গিয়ে তিনবার বিভিন্ন সংশোধনীসহ বিলটি পুনরায় উত্থাপন করেন কিন্তু প্রতিবারই তা একই ভাগ্যবরণ করে। ধীরেন দত্তের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় সফলভাবে শান্তিপূর্ণ ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়।
২৮ ফেব্রুয়ারী তমদ্দুন মজলিস ও পূর্ববঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ এক সভায় মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, পাকিস্তান গণপরিষদের সরকারি ভাষার তালিকা থেকে বাংলাকে বাদ দেয়া, পাকিস্তানের মুদ্রা ও ডাকটিকিটে বাংলা ভাষা ব্যবহার না করা এবং নৌবাহিনীতে নিয়োগের পরীক্ষা থেকে বাংলাকে বাদ দেয়ার প্রতিবাদে ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালনের। সভায় আরো দাবি করা হয় যে, বাংলাকে অবিলম্বে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ববঙ্গের সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।
১১ মার্চের ধর্মঘটের প্রতি চারদিক থেকে সমর্থন আসতে থাকে। ধর্মঘটকে সামনে রেখে ২ মার্চ ফজলুল হক হলে বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের সমন্বয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন কামরুদ্দীন আহমদ। এ সভায় উপস্থিত ছিলেন রণেশ দাসগুপ্ত, অধ্যাপক আবুল কাশেম, অজিত কুমার গুহ, আজিজ আহমদ, সরদার ফজলুল করিম, নঈমুদ্দীন আহমদ, তফাজ্জল আলী, শামসুদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আলী আহমদ, শহীদুল্লাহ কায়সার, অলি আহাদ, শওকত আলী, শামসুল হক, লিলি খান, আনোয়ারা খাতুন, মহিউদ্দিন, শামসুল আলম, কাজী গোলাম মাহবুব, আবদুল আউয়াল, তাজউদ্দীন আহমদ, প্রমুখ। সভায় ২৮ জন সদস্য নিয়ে “সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” গঠিত হয়। এর আহ্বায়ক নিযুক্ত হন শামসুল আলম। ওই সভায় ভাষা আন্দোলনকে সুষ্ঠু ও সাংগঠনিক রূপ দেওয়ার তাগিদে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সারা পূর্ববঙ্গে ধর্মঘট আহ্বান করা হয়।
১১ মার্চ ভোর থেকেই দলে দলে ছাত্রদের জমায়েত শুরু হয় সচিবালয়ের মূল দুটি গেটে। একদল ইডেন বিল্ডিঙ অর্থাৎ আব্দুল গণি রোডের ১ নম্বর গেটে এবং এই গেটের কাছাকাছি জিপিওর সামনে আরেকদল তোপখানা রোডের পাশে টিনশেডের ২ নম্বর গেটে অবস্থান নেয়। ১ নম্বর গেটে পিকেটিং করেন শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, নাইমুদ্দিন আহমেদ, শওকত আলী, আজীজ আহমেদ, প্রমুখ। তোপখানা রোডস্থ ২ নম্বর গেটে পিকেটিংয়ে নেতৃত্ব দেন কাজী গোলাম মাহবুব, শওকত আলী, খালেক নওয়াজ, প্রমুখ।
সকাল আটটার দিকে জিপিওর সামনে আর নয়টার দিকে ১ ও ২ নম্বর গেটে লাঠিচার্জ হয়। পুলিশের ক্রোধান্ধ লাঠিচার্জে খালেক নেওয়াজ খান, বখতিয়ার, এম এ ওয়াদুদ, কাজী গোলাম মাহবুব, ওলি আহাদসহ অসংখ্য আহত হন। গ্রেফতার হন শেখ মুজিবুর রহমান, কাজী গোলাম মাহবুব, শামসুল হক, আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী, অলি আহাদ, শওকত আলী, খালেক নওয়াজ খান, নঈমুদ্দিন আহমদ, রণেশ দাস গুপ্তসহ আরো অনেকে।
১১ মার্চের ধর্মঘটে সরকারি নিপীড়নের প্রতিবাদে ১২ মার্চ বিক্ষিপ্ত প্রতিবাদ, ১৩ মার্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট, ১৪ মার্চ সারা পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মঘট পালিত হয়। ১৯৪৮ এ গড়ে ওঠা এ আন্দোলন শুধু ঢাকা কেন্দ্রিক ছিল না তা ছড়িয়ে পড়ে সারা পূর্ববঙ্গে। সে সময় পাবনা, যশোর, রাজশাহী, চাঁদপুর, বিক্রমপুর, বগুড়া, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, ময়মনসিংহে ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে আন্দোলন সূচিত হয়।
ফলে, ১৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অনুষ্ঠিত সভায় ছাত্রদের “বাংলাকে প্রাদেশিক সরকারি ভাষার মর্যাদা দান”-সহ ৭ দফা দাবি মূখ্যমন্ত্রী (প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী) খাজা নাজিমউদ্দীন মেনে নিতে বাধ্য হন। ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে মুখ্যমন্ত্রীর নতি স্বীকার ছিল ঐতিহাসিক ও ভাষা আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ চুক্তির ভিত্তিতে ১৫ মার্চ সন্ধ্যায় ১১ মার্চে গ্রেফতারকৃত ছাত্র নেতা-কর্মীদের মুক্তি দেয়া হয়।
কিন্তু মূখ্যমন্ত্রীর সে নতি স্বীকার যে ছিল কেবলই এক নাটক জিন্নাহ তা জানিয়ে দিলেন। ২১ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এক নাগরিক সংবর্ধনায় সদম্ভে ভাষা আন্দোলনকারীদের কমিউনিস্ট ও বিদেশি এজেন্ট বলে চিহ্নিত করে জনগণকে সতর্ক করে দিয়ে উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করলেন।
২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জিন্নাহ একই ঘোষণা, “The State language, therefore, must obviously be Urdu, a language that has been nurtured by a hundred million Muslims of this sub-continent, a language understood throughout the length and breadth of Pakistan and above all a language which, more than any other provincial language, embodies the best that is in Islamic culture and Muslim tradition and is nearest to the language used in other Islamic countries” দিলে আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে ছাত্ররা না, না বলে চিৎকার করে প্রতিবাদ জানায়।
একই দিন সন্ধ্যায় জিন্নাহর সাথে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দের বৈঠকে ছাত্রদের ৮ দফা (পরবর্তীতে ৭ দফার সাথে ছাত্রদের চাপের মুখে খাজা নাজিমউদ্দীন আরও এক দফা যুক্ত করে নেন) মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানালে ছাত্ররা হইহট্টগোল করে পক্ষান্তরে জিন্নাহকে অপমান করে। কিন্তু তাতেও জিন্নাহগঙের কোন বিকার ঘটলো না। কেননা ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে এক রেডিও ভাষণে জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে তার মনোভাব পুনর্ব্যক্ত করলেন। ততক্ষণে পূর্ববঙ্গের ছাত্র-জনতার বোঝা হয়ে গেছে যে নাজিমুদ্দীনের “৭ দফা চুক্তি” কেবলই জিন্নাহর পূর্ববঙ্গ সফর নির্বিঘ্ন করবার একটি চাল ছিল।
বস্তুত রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পক্ষে-বিপক্ষে বিবদমান দুই অংশের নেতৃত্বেই ছিল মূখ্যতঃ ‘পাকিস্তান আন্দোলন” এর নেতা-কর্মী। রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পূর্ববঙ্গের নেতা-কর্মীদের চোখে তখনও ‘পাকিস্তান’ নামের কালো চশমা। ফলে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া ব্যাপক আন্দোলন তথা সংগ্রামের উপর আস্থা না রেখে তারা আস্থা রাখলেন জিন্নাহগংদের উপর।
নেতৃত্বের এই আপোষকামীতায় ফলাফল যা হবার তাই হলো আন্দোলন হারাল তার নেতৃত্ব আর রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে ভেতরে চলতে লাগল শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান ও মুসলিম লীগ নেতা মওলানা আকরম খাঁর নেতৃত্বে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার হীন চক্রান্ত।
মুখ থুবড়ে পড়ল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন তথা বাঙালী জাগরণের প্রথম সংগ্রাম। যার মাথা তুলে দাঁড়াতে লেগে গেল আরও ৪টি বছর।
লেখক: সাগর লোহানী, সম্পাদক, বাঙালীয়ানা
ফিচার ফটো: কালের কন্ঠ