৬ দফা ও শেখ মুজিব: পূর্বাপর । সাগর লোহানী

Comments

৫২ –র ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালীর জাতীয়তাবাদী চিন্তা চেতনার উন্মেষের সাথে সাথে পূর্ব বাংলার সাথে পাকিস্তানীদের বৈষম্যমূলক আচরণ, সাংস্কৃতিক বৈপরিত্য আর অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে বাঙালীর ক্ষোভ বাড়তে থাকে। এরই প্রকাশ ঘটে ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে।

১৯৫১ সালে পূর্ব বাংলার আইনসভার যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ছিল তা বিভিন্ন অজুহাতে কয়েকবার স্থগিতকরণ ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ক্ষমতালোভী অভিসন্ধিরই নামান্তর।

১৯৫৩ সালের নভেম্বর মাসে পাকিস্তানের ৪টি রাজনৈতিক দল একটি একুশ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করে।পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের পাশাপাশি ২১-দফার ইশতেহারে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং অর্থ দপ্তর বাদে অন্যান্য সকল বিষয় কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক সরকারের নিকট হস্তান্তর করার দাবী উত্থাপন করা হয়। ইশতেহারে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদান, রাজবন্দিদের মুক্তি, পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর সরকারী বাসভবন বর্ধমান হাউসকে বাংলা একাডেমী ভবনে রূপান্তর, ১৯৫২ সালে ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণের স্থানে শহীদ মিনার নির্মাণ, ২১ ফেব্রুয়ারীকে সরকারী ছুটির দিন ঘোষণা, ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন প্রদান, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার নীতিমালা অনুসারে কলকারখানার শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার প্রবর্তন, পাটশিল্প জাতীয়করণ, পণ্যের মূল্যমানের যথার্থতা নিশ্চিতকরণ এবং সমবায়ী প্রতিষ্ঠান ও কুটিরশিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারী সহায়তা প্রদান ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল।

মূলত মুসলিম লীগের সামগ্রিক ব্যর্থতা এবং বিবিধ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণে ঐক্যের আকাংখায় ঐ ইশতেহারের ভিত্তিতে ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বরে আওয়ামী মুসলীম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, গণতন্ত্রী দল ও নেজামে ইসলামী ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠন করে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ৭ বছরের মধ্যে ১৯৫৪ সালের ৮-১২ মার্চে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। মুসলিম লীগ যুক্তফ্রন্টের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। এই নির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রাদেশিক পরিষদের সর্বমোট ৩০৯ আসনের মধ্যে মাত্র ৯ আসন লাভ করে।

পূর্ব বাংলায় যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ বিজয়ে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন সেই এ.কে ফজলুল হক,  হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী শেষ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারলেন না। এক বছর পার হতে না হতেই মূলত ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব ও মতানৈক্যের কারণে যুক্তফ্রন্টের ঐক্যে ভাঙ্গন দেখা দেয়।

১৯৫৪ সালে দলীয় আপত্তি উপেক্ষা করে বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর মন্ত্রিসভায় আইনমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের সংবিধান প্রণয়নে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আইনমন্ত্রী থাকাকালে সোহ্‌রাওয়ার্দীর বলিষ্ঠ ও উদ্যোগী ভূমিকার সুবাদেই পাকিস্তানের দুই অংশের নেতৃবৃন্দের মধ্যে ১৯৫৫ সালে মারী চুক্তি সম্ভব হয় এবং এই চুক্তি পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারীতে সংবিধান প্রণয়নের পথ সুগম করে। পাকিস্তানের এই সংবিধানেই অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃতি পায়।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এসময়ে মার্কিন ঘেঁষা পাক পররাষ্ট্রনীতি এবং প্রতিরক্ষানীতির সমর্থক হয়ে পড়েন। পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি এবং সিয়েটো, সেন্টো চুক্তি স্বাক্ষর হলে তার দল আওয়ামী লীগে এর প্রবল সমালোচনা ওঠে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এ প্রসঙ্গে দলের বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে পাকিস্তানের সম্পৃক্ত হবার বিরোধীতা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলে এক ছাত্র সভায় বলেন, শূন্য প্লাস শূন্য ইকুয়েলস টু শূন্য (০+০=০)।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একগুঁয়ে আচরণে কাগমারী সম্মেলনে আওয়ামী লীগ ভেঙ্গে যায়। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে যান এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন।

একই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী সোহ্‌রাওয়ার্দী ‘নতুন সংবিধানে ৯৮% স্বায়ত্বশাসন দেয়াই হয়ে গেছে’ উল্লেখ করে সমালোচিত হন। ১৯৫৭ সালের ১০ অক্টোবর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মাত্র ১৩ মাস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন।

জেনারেল ইসকান্দর মির্জার স্বল্পস্থায়ী আমল ও পরে জেনারেল আইয়ুব খানের আমলে পাকিস্তানের দু অংশের মধ্যকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং পূর্ব পাকিস্তানে ক্রমবর্ধমান পশ্চিম পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসনের যাঁতাকল জেঁকে বসে।

১৯৬৩-র ডিসেম্বরে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে পৌরোহিত্যের আসন লাভ করেন অলিখিত ভাবেই। সোহরাওয়ার্দী-প্রভাব মুক্ত শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালীর স্বাধীকারের প্রশ্নে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। তার প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় ছাত্রলীগ আর তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ। এসময় থেকে “ইনার সার্কেল” নামে একটি ক্ষুদ্র পরামর্শক গোষ্ঠীর কার্যক্রম গড়ে ওঠে শেখ মুজিবকে ঘিরে যার সূত্রধর হয়ে ওঠেন তাজউদ্দীন আহমদ।

১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের অবসানের পর পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের চরম অবহেলা ও ঔদাসীন্যের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান সোচ্চার হন। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় নেতারা তাসখন্দ-উত্তর রাজনীতির গতিধারা নিরূপণের উদ্দেশ্যে ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী লাহোরে এক জাতীয় সম্মেলন আহবান করেন। আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সম্মেলনে যোগদানের জন্য ৪ ফেব্রুয়ারী লাহোর পৌঁছোন। পরদিন সাবজেক্ট কমিটির সভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবি হিসেবে ‘ছয়দফা’ প্রস্তাব পেশ করেন এবং তা সম্মেলনের আলোচ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। কিন্তু সম্মেলনের উদ্যোক্তারাই শুধু নন আতাউর রহমান খানের মত বাঙালী নেতারাও এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। শেখ মুজিব গণমাধ্যমে ৬ দফা প্রকাশ করে ৬ ফেব্রুয়ারীর সম্মেলন বর্জন করে ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। ৭ ফেব্রুয়ারী পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকাংশ পত্রপত্রিকা শেখ মুজিবকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে চিত্রিত করে।

৬ দফা প্রণয়নে সেই ‘ইনার সার্কেল’কে তৎপর হতে দেখা যায়। সেই সার্কেলে যুক্ত অন্যতম সদস্যদেরে মধ্যে দুজন সি এস পি কর্মকর্তা ছিলেন, রুহুল কুদ্দুস ও আহম্মেদ ফজলুর রহমান।

পরবর্তী সময়ে ৬ দফা প্রণয়ন সম্পর্কে বলতে গিয়ে রুহুল কুদ্দুস বলেন, ”ছয় দফার একশ ভাগ আমারই তৈরী। প্রথমে এটা ছিল সাত দফা। সাত দফার খসড়া তৈরীর পর আমি এটা তাজউদ্দিন সাহেবকে দেখাই। উনি শেখ মুজিবের সাথে আলাপ- আলোচনা করে একটি দফা বাদ দেন। কপিটি আমি টাইপ করাই তৎকালীন ইউনাইটেড ব্যাংক অব পাকিস্তানের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট আমার বন্ধু খায়রুল কবিরের অফিস থেকে। আমি তখন কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের ফাইন্যান্স ডাইরেক্টর।”

এদিকে লাহোর রওনা হবার আগে শেখ মুজিব ৬ দফার খসড়াটি সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরীর কাছে পাঠিয়ে দেন। গাফফার চৌধুরী এই খসড়াটি ঢাকার সান্ধ্য দৈনিক ‘আওয়াজ’ এ প্রকাশ করেন। তবে শেখ মুজিবের ভরসার জায়গা ইত্তেফাক বেশ অনেকগুলো দিন ৬ দফা প্রকাশে বিরত থাকে। অবশ্য পরে জনমত ছয়দফার পক্ষে এলে ইত্তেফাক এতে সমর্থন দেয়।

কী ছিল এই ৬ দফায়?
১.   লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিণত করতে হবে, যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ সার্বভৌম হবে;
২.   ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে শুধু দুটি বিষয়, প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক, এবং অপর সব বিষয় ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত রাজ্যসমূহের হাতে ন্যস্ত থাকবে;
৩.   পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু করতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে সমগ্র পাকিস্তানের জন্য ফেডারেল সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটিই মুদ্রাব্যবস্থা থাকবে, একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও দুটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থাকবে। তবে এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পুঁজি যাতে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে তার ব্যবস্থা সম্বলিত সুনির্দিষ্ট বিধি সংবিধানে সন্নিবিষ্ট করতে হবে;
৪.   দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক হিসাব থাকবে এবং অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা রাজ্যের হাতে থাকবে। তবে ফেডারেল সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দুই অঞ্চল থেকে সমানভাবে কিংবা উভয়ের স্বীকৃত অন্য কোনো হারে আদায় করা হবে;
৫.   দুই অংশের মধ্যে দেশিয় পণ্য বিনিময়ে কোনো শুল্ক ধার্য করা হবে না এবং রাজ্যগুলো যাতে যেকোন বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে সংবিধানে তার বিধান রাখতে হবে।
৬.   প্রতিরক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে আধা-সামরিক রক্ষীবাহিনী গঠন, পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা স্থাপন এবং কেন্দ্রীয় নৌবাহিনীর সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করতে হবে।

৬ দফা দলীয় কর্মসূচীতে পরিণত করবার প্রক্রিয়ায় এরপর সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ নিজেই। শেখ মুজিব তা আগেই টের পেয়েছিলেন। তাই তিনি লাহোর থেকে ১১ ফেব্রুয়ারী ঢাকা ফিরে ছাত্রনেতা ও অন্যান্যের সাথে আলোচনার করতে থাকেন।

১৩ ফেব্রুয়ারী প্রথম চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ এবং তারপর দিন ১৪ ফেব্রুয়ারী ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি প্রকাশ্য বিবৃতির মাধ্যমে ৬ দফার প্রতি সমর্থন প্রদান করে। ৬ দফা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৭ ফেব্রুয়ারী আওয়ামী লীগ অফিসে আহূত সংবাদ সম্মেলনে প্রস্তাবিত ৬ দফার বিশদ ব্যাখ্যা দেন শেখ মুজিব।

শেখ মুজিবুর রহমান ২১ ফেব্রুয়ারী আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সভা ডাকলেন ৩২ নম্বরে। উপস্থিত অনেক সদস্যই ছয় দফা সমর্থনে রাজী ছিলেন না। এরা ৬ দফার প্রবল বিরোধীতায় লিপ্ত হন।

১৩ মার্চ আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির জরুরী সভা আহবান করা হয়। সেই সভায় দলের অভ্যন্তরে প্রবল সমালোচনা ও মতবিরোধের নিরসন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের লক্ষ্যে ১৮ ও ১৯ মার্চ ইডেন হোটেলে দলের বিশেষ কাউন্সিল আহবান করা হয়।

কিন্তু এই ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকেই মতবিরোধের এক পর্যায়ে দলের সভাপতি মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ তার অনুসারীদের নিয়ে বৈঠকস্থল ত্যাগ করেন। ১৮ ও ১৯ মার্চ ইডেন হোটেলে দলের বিশেষ কাউন্সিলেও তিনি অনুপস্থিত থাকায় সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সভাপতিত্ব করেন। ১৯ তারিখের কাউন্সিলেই ১৪৪৩ জন কাউন্সিলর শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দিন আহমদকে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করেন। সেই কাউন্সিলেই ঢাকা মহানগর সভাপতি বাহাউদ্দিন চৌধুরীর প্রস্তাব ও ঢাকা জেলা সভাপতি শামসুল হকের সমর্থনের মধ্য দিয়ে ৬ দফার ভিত্তিতে সংশোধিত দলীয় গঠনতন্ত্রের খসড়া অনুমোদন এবং ৬ দফা সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়।

১৯ মার্চ আওয়ামী লীগের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ৬ দফা বিষয়ে বর্ণনা করে বলা হয়, ‘উল্লিখিত ৬ দফাভিত্তিক দলীয় কর্মসুচী পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার এবং এই প্রদেশের আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থার পুনরুজ্জীবনের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক, বাস্তব ও সুপারিশযোগ্য কর্মসুচী’। প্রচারিত লিখিত বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই দাবীগুলোর অন্যতম আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন মুলত রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের জন্ম নেওয়ারও আগের। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ জন্মলগ্ন থেকেই আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের দাবি জানিয়ে আসছে’।

শেখ মুজিব বলেন, ‘৬ দফা দাবী জনগণের বিপুল সাড়া লাভ করেছে কারণ, এই বিষয়গুলি নতুন কোনো আবিষ্কার নয় বরং প্রকৃতপক্ষে জনগণেরই দীর্ঘকালের দাবী, আর তাদের নেতাদের অঙ্গীকারও বটে। যা কয়েক দশক ধরে পূরণের অপেক্ষায় রয়েছে’।

২০ মার্চ নতুন কমিটির উদ্যেগে প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয় পল্টন ময়দানে। পরবর্তি ৩৫দিনে দেশের ৩২টি জনসভায় ৬ দফার পক্ষে বক্তৃতা করেন শেখ মুজিবুর রহমান। 

৬ দফা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সরকারী প্রচারযন্ত্র শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে। ১৯৬৬ এর মার্চ মাসে ঢাকায় কনভেনশন মুসলীম লীগের জনসভায় আইয়ুব খান বলেন, “যারা ৬ দফার কথা বলবে সেসব বিশৃঙ্খলাকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে ‘অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ’ করা হবে”।

কাউন্সিল মুসলিম লীগ ৬ দফাকে ‘পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করে বলে, “পাকিস্তানের ভবিষ্যত শাসনতন্ত্রের ভিত্তি কোনোভাবেই ৬ দফা হতে পারে না, কারণ এটি কনফেডারেশন নয় বরং ফেডারেশন গঠনের দাবী”।

জামায়াতে ইসলামী বলে, “পাকিস্তানকে বিভক্ত করে ভারতীয় আগ্রাসনের শিকারে পরিণত করে সমগ্র পাকিস্তানের অস্তিত্ত্বের উপর হুমকি হিসেবে ৬ দফা প্রণয়ন করা হয়েছে এবং এটি নিশ্চিতভাবেই বিচ্ছিন্নতার লক্ষ্যে পরিচালিত একটি আন্দোলন”।

নেজামে ইসলামী ৬ দফাকে প্রত্যাখ্যান করে বলে, “শেখ মুজিব একক ও একনায়কীয় কায়দায় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে”।

মওলানা ভাসানীর ন্যাপ যুক্তি দেখায়, “এতে ভুখা নাঙ্গা মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির কোন নির্দেশনা নেই এবং এতে সাম্রাজ্যবাদী দালালদের হাত থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্ত করার কোনো দাবিই নেই”।

মোজাফফর আহমদের ন্যাপ এটিকে সিআইএ’এর আয়োজিত ও মস্তিষ্ক প্রসূত পরিকল্পনা হিসেবে অভিহিত করে।

অবশ্য দুই ন্যাপই পরবর্তিতে বিভিন্ন দফা ভিত্তিক কর্মসুচী গ্রহণ করে এবং সেখানে স্বায়ত্বশাসনের দাবী সন্নিবেশিত হয়।

১৯৬৬ সালের ১৩ মে আওয়ামী লীগ আয়োজিত পল্টনের এক জনসভায় ৬ দফা দাবী আদায়ের লক্ষ্যে ৭ জুন হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সারা জুন মাসব্যাপী ৬ দফা প্রচারে বিপুল কর্মসূচি নেয়া হয়। ৭ জুন তেজগাঁওয়ে বেঙ্গল বেভারেজের শ্রমিক মনু মিয়া গুলিতে শহীদ হন। আজাদ এনামেল অ্যালুমিনিয়াম কারখানার শ্রমিক আবুল হোসেন ইপিআরের গুলিতে শহীদ হন। একই দিন নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনের কাছে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন ৬ জন শ্রমিক। এতে বিক্ষোভের প্রচন্ডতা আরো বেড়ে যায়। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে কার্যত সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না ফলে সন্ধ্যায় কারফিউ জারি করা হয়। হাজার হাজার আন্দোলনকারী মানুষ গ্রেফতার হয়। বহু জায়গায় জনতা গ্রেফতারকৃতদের ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ৬ দফাভিত্তিক আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। শহীদের রক্তে আন্দোলনের নতুন মাত্রা গড়ে ওঠে। ৭ জুনে ছাত্র-জনতার এ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যায় শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষ।

অনিবার্যভাবেই গ্রেফতার হন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদসহ অসংখ্য নেতা।

শেখ মুজিব ঘোষিত ৬ দফা দাবী পাকিস্তানের ‘লৌহ মানব’ খ্যাত তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খানকে করে তোলে বিচলিত। আইয়ুব শেখ মুজিবুর রহমানকে তার সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করে এবং শেখ মুজিবের বিনাশের চক্রান্তে মেতে ওঠে।

১৯৬৮ তে জেল থেকে ছেড়ে জেল গেট থেকেই নিরাপত্তা আইনে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে।

বাঙালীকে নেতৃত্বহীন করার লক্ষ্যে শেখ মুজিবকে ফাঁসী দেয়ার চক্রান্ত রচিত হয়। ৩৫ জনকে আসামী করে শুরু হয় “রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য” মামলা। এই তথাকথিত ষড়যন্ত্রের সাথে “ভারত” এর যুক্ততা বিশ্বাসযোগ্য করতে অনানুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমে এই মামলাকে পরিচিত করা হয় “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা” নামে।

কিন্তু আইয়ুবের কি দুর্ভাগ্য সেই ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিতে অভিযুক্ত সকলেই অস্বীকার করেন তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ। সাজানো সাক্ষীরাও বেঁকে বসেন আদালতে। জনগণ জ্বলে ওঠে আইয়ুবের বিরুদ্ধেই। সার্জেন্ট জহুরকে হত্যা করে সে আগুনে ঘি ঢালে আইয়ুব নিজেই। ঢাকার রাজপথে জনতার ঢল নামে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে “চল চল ক্যান্টনমেন্ট চল” শ্লোগানে। আসাদ, মতিয়ুর। আনোয়ারা বেগমের রক্তে উজ্জীবিত আন্দোলন রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে।

আইয়ুবের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। ২২ ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৯, মাথা নামিয়ে আইয়ুব খান মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়, বাধ্য হয় অভিযুক্তদের মুক্তি দিতে।

পক্ষান্তরে, ৩৩ মাস কারাবাসের পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

লেখক:

সাগর লোহানী
সম্পাদক, বাঙালীয়ানা

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.