৭৫ বছর আগের ২১ অক্টোবর

Comments

।। সাগর লোহানী ।।

বলুন তো কি ঘটেছিল ৭৫ বছর আগের ২১ অক্টোবরে?

ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দিন এই ২১ অক্টোবর। কয়েকজন দেশপ্রেমিক বাঙালীর রক্তে আগুন ধরিয়েছিলেন আরও এক বাঙালী যাঁর নাম সুভাষচন্দ্র বসু, যিনি সেদিন থেকে পরিচিত হলেন “নেতাজি” নামে।

INA - 7

নেতাজি আজাদ হিন্দ ফৌজের জমায়েতে লিখিত ভাষণ দিচ্ছেন। ছবি: ইন্টারনেট

তিনি বলেছিলেন, “যে স্বপ্নে আমরা বিভোর হয়েছি তা’ শুধু স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন নয়। আমরা চাই ন্যায় ও সাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত এক স্বাধীন রাষ্ট্র – আমরা চাই এক নূতন সমাজ ও এক নূতন রাষ্ট্র, যার মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠবে মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ ও পবিত্রতম আদর্শগুলি।”

১৯৪২ সালের মার্চ মাসে জাপানের রাজধানী টোকিওতে ভারতীয়দের একটি সম্মেলনে গঠিত হয় ‘ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স লিগ’ বা ‘ভারতীয় স্বাধীনতা লিগ’। ১৯৪২ সালে ব্যাংককে আরও একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনেই রাসবিহারী বসুকে লিগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয় এবং আজাদ হিন্দ বাহিনী (ইংরেজিতে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা আইএনএ) নামে একটি সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

INA-3

নেতাজি আজাদ হিন্দ ফৌজ পরিদর্শন করছেন। ছবি: ইন্টারনেট

ক্যাপ্টেন মোহন সিং, যিনি নিজেও জাপানিদের হাতে যুদ্ধবন্দী ছিলেন, ১৯৪২ এর এপ্রিলে অপরাপর যুদ্ধবন্দী ৭০,০০০ ভারতীয় বৃটিশ সেনা নিয়ে গড়ে তোলেন আজাদ হিন্দ ফৌজ। কিন্তু সমরক্ষেত্রে আজাদ হিন্দ ফৌজের কার্যক্রম নিয়ে জাপানী সমর অধিনায়কদের সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে মতানৈক্যের এক পর্যায়ে ‘৪২ এর ডিসেম্বরে ক্যাপ্টেন মোহন সিং আজাদ হিন্দ ফৌজ বিলুপ্ত করেন। ১৯৪২ এর ব্যাংকক সম্মেলনেই সুভাষচন্দ্র বসুকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্বভার গ্রহণ করবার জন্যে। সুভাষচন্দ্র ১৯৪৩ সালের ১১ মে তে টোকিও এসে পৌঁছলেন। আলোচনায় বসলেন রাজকীয় জাপানী সেনাবাহিনীর জেনারেল হিদাকি তোজো’র সাথে। “আজাদ হিন্দ ফৌজ” এর রণনীতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নিলেন সে আলোচনায়। জুলাই মাসে সিঙ্গাপুরে এলেন সুভাষচন্দ্র বসু। রাসবিহারী বসু সুভাষচন্দ্রের  পুনর্সংগঠিত আজাদ হিন্দ ফৌজের ভার তুলে দিলেন। “আজাদ হিন্দ ফৌজ” সুভাষচন্দ্র বসুকে পূর্ণাঙ্গ সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানালো এবং তাদের “নেতাজি” হিসেবে ভালোবাসার আসনে বসালো।

INA - 8

নেতাজি আজাদ হিন্দ ফৌজের অভিবাদন গ্রহণ করছেন। ছবি: ইন্টারনেট

সিঙ্গাপুরেই ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর নেতাজি “আর্জি-হুকুমত-এ-আজাদ হিন্দ” বা “অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকার” প্রতিষ্ঠা করলেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আনুষ্ঠানিকভাবে হলেন আজাদ হিন্দ সরকারের রাষ্ট্রপতি এবং সমর ও পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী।

INA - 9

নেতাজি ঝাঁসির রানী রেজিমেন্ট পরিদর্শন করছেন সংগে ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগল। ছবি: ইন্টারনেট

ক্যাপ্টেন ডাক্তার লক্ষ্মী স্বামীনাথন (লক্ষ্মী সেহগল) ছিলেন নারী সংগঠন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী। এই দায়িত্বের সঙ্গে সঙ্গে তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের মহিলা ব্রিগেড ঝাঁসির রানী রেজিমেন্ট কম্যান্ডের দায়িত্বেও ছিলেন। এশিয়ায় এই ধরণের নারীবাহিনী ছিল সেটাই প্রথম এবং এক সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। ডা: লক্ষ্মী ছিলেন সিঙ্গাপুরের এক বিশিষ্ট স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ। পরে তিনি তাঁর লোভনীয় কর্মজীবন ত্যাগ করে আজাদ হিন্দ ফৌজের ঝাঁসির রানী রেজিমেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকারের মন্ত্রিসভার অন্যান্য মন্ত্রীরা ছিলেন:

এস. এ. আইয়ার – সম্প্রচার ও প্রচারণা মন্ত্রী
লেফট্যানেন্ট কর্নেল এ. সি. চ্যাটার্জি – অর্থমন্ত্রী

আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতিনিধি হিসেবে যাঁরা মন্ত্রী ছিলেন এঁরা হলেন:

লেফট্যানেন্ট কর্নেল আজিজ আহমেদ
লেফট্যানেন্ট কর্নেল এন. এস. ভগত
লেফট্যানেন্ট কর্নেল জে. কে. ভোঁসলে
লেফট্যানেন্ট কর্নেল গুলজারা সিংহ
লেফট্যানেন্ট কর্নেল এম. জেড. কিয়ানি
লেফট্যানেন্ট কর্নেল এ. ডি. লোকণাথন
লেফট্যানেন্ট কর্নেল এহসান কাদির
লেফট্যানেন্ট কর্নেল শাহনওয়াজ খান

আজাদ হিন্দ সরকার সংগঠন ও প্রশাসন পরিচালনার জন্য নিযুক্ত হয়েছিলেন একাধিক সচিব ও উপদেষ্টা। এঁরা হলেন:

এ. এন. সহায় – সচিব
করিম ঘানি
দেবনাথ দাস
ডি. এম. খান
এ. এল্লাপা
জে. থিভি
সর্দার ইসের সিংহ
এ. এন. সরকার – আইন উপদেষ্টা

Flag of INA

আজাদ হিন্দ ফৌজের পতাকা। ছবি: ইন্টারনেট

কংগ্রেসের ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা গৃহীত হয় ভারতের জাতীয় পতাকা হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’ গানটি নির্বাচিত হয় ভারতের জাতীয় সংগীত হিসেবে।

INA - 4

আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানায়কদের সাথে নেতাজি। ছবি: ইন্টারনেট

নেতাজি আজাদ হিন্দ ফৌজের দুটি প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেন – একটি রেঙ্গুনে, অপরটি সিঙ্গাপুরে। জাপান সেনাবাহিনী ব্রিটিশদের যুদ্ধে হারিয়ে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অধিকার ব্রিটিশদের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিল। ১৯৪৩ সালের নভেম্বরে এই দ্বীপাঞ্চল জাপানি কর্তৃপক্ষ তুলে দেয় আজাদ হিন্দ সরকারের হাতে। নেতাজি স্বয়ং আসেন আন্দামানে। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের নামকরণ করেন ‘শহীদ ও স্বরাজ দ্বীপপুঞ্জ’।

লেখক পরিচিতি:

সাগর লোহানী, সম্পাদক, বাঙালীয়ানা

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.