৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ মঙ্গলবার
কী ঘটেছিল
হেডকোয়ার্টার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন রংপুরের শঠিবাড়ি বন্দরে ৩১৫ জন মুক্তিযোদ্ধারা অসীম বীরত্বে সারারাত হানাদারবাহিনীর ছয় ইঞ্চি মর্টার ও রকেট লঞ্চারের বিরুদ্ধে থ্রি নট থ্রি হাতে ৪ দিনের যুদ্ধে জয় লাভ করে। সকাল ৭টার দিকে পাকবাহিনী শঠিবাড়ি ছেড়ে নীলফামারীর দিকে পালিয়ে যায়। ৪ দিন কেবলমাত্র সামান্য বিস্কুট এবং জল খেয়ে লড়াই চালানো মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আহত কমান্ডার হারেসউদ্দিন সরকার শঠিবাড়ির আকাশে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দেন।
৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীর ঝাউডাঙ্গা অবস্থানের ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এতে পাক হানাদারবাহিনীর ২ জন পাঞ্জাবি পুলিশ নিহত ও ৪ জন আহত হয়। এই অভিযানে মুক্তিযোদ্ধা দল ৬টি রাইফেল ও কিছু গোলাবারুদ দখল করে।
৮ নম্বর সেক্টরে অপর এক মুক্তিফৌজদল মধুখালী-দোসাতিনা সড়কে পাকসেনাবাহিনী ও রেঞ্জারদের সম্মিলিত একটি দলকে অ্যামবুশ করে। এতে পাকবাহিনীর ২৬ জন সৈন্য নিহত হয়।
৬ নম্বর সেক্টরের থোকরাবাড়ী ইয়ূথ ক্যাম্পের মুক্তিফৌজ দলনেতা মো. খোরশেদ আলমের নেতৃত্বে ২৫-৩০ জনের একটি দল ঠাকুরগাঁও থানা এলাকার বড়বাড়ী গ্রামের তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম নেতা রাজেন সিংয়ের বাড়িতে অবস্থান নেয়ার পর সকাল ৮টায় পাকসেনারা আকস্মিক হামলা করে। মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই যুদ্ধে ষাটোর্ধ রাজেন সিং ৩০৩ রাইফেল হাতে হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। দুপুর ১২টার পর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধে পাকসেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
৬ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনী জগদলহাটে পাকসেনাদের অবস্থানের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। এ সংঘর্ষে পাকসেনারা পর্যুদস্ত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা জগদলহাট দখল করে। কিছুক্ষণ পর পাকহানাদার বাহিনী গোলন্দাজ ও জিপে বসানো মেশিনগানের সাহায্যে মুক্তিবাহিনীর ওপর পাল্টা আক্রমণ চালায়। পাকসেনাদের এই আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করে।
কুমিল্লা অঞ্চলে পাকবাহিনীর একদল সৈন্য সিলোনিয়া নদীর পশ্চিমে মুহুরি নদী অতিক্রমের চেষ্টা করার সময় মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়ে। এতে একজন পাক অফিসারসহ বেশ কয়েকজন হতাহত হলেও হানাদারবাহিনী পালটা আক্রমণ চালায়। যুদ্ধ বেশ কিছু সময় ধরে চলে।
৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশ দল গোয়ালগ্রামে পাকবাহিনীর এক কোম্পানি সৈন্যের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এতে ১৯ জন পাকসৈন্য নিহত ও অনেক আহত হয়। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর ৩ জন যোদ্ধা গুরুতর আহত ও ৫ জন নিখোঁজ হয়।
দিনাজপুরের চুই নদীর পশ্চিমদিকের হানাদার অবস্থানের উপর মুক্তিবাহিনীর ছোট ছোট আক্রমণ আগস্ট মাস থেকে চলছিল কিন্তু তেমন সফলতা আসছিল না। সেপ্টেম্বরের শুরুতে আক্রমণ তীব্রতর হয়। এক পর্যায়ে বিএসএফের ৭৩ ব্যাটেলিয়ন ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর আর্টিলারী রেজিমেন্টের গোলন্দাজ আক্রমণের সহায়তা পায় মুক্তিবাহিনী। এর ফলে চুই নদীর পশ্চিমদিকের চকরমারী, ফকিরপাড়া, খইপাড়া, ভাঙ্গাপাড়া, পাথিলাগাঁও, জুতরারপাড়া, খাসপাড়া, বালিয়াপাড়া, প্রধানপাড়াসহ চুই নদীর সমগ্র পশ্চিমাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।
সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে পটুয়াখালী ও বরগুনার ৮টি থানাকেন্দ্র ছাড়া সমগ্র অঞ্চল মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
পাকিস্তানি সামরিক জান্তার এক ঘোষণায় বলা হয়, শেখ মুজিবের বিচার কার্যে এ পর্যন্ত মোট ২০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। এই ঘোষণার উদ্ধৃতি দিয়ে রাওয়ালপিন্ডি থেকে এপিএ জানায়, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার চলছে। ঘোষণায় বলা হয়, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অভিযোগে এই দিন মুজিবের গোপন বিচার পুনরায় শুরু হয়েছে। সামরিক জান্তা জানায়, এ কে ব্রোহী, তিনজন সহকারী গোলাম আলি, আকবর মির্জা এবং গোলাম হোসেনের সহায়তায় শেখ সাহেবের পক্ষ সমর্থন করেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানী সংবাদপত্রে শেখ মুজিবের মুক্তির সম্ভাবনা সম্পর্কে জল্পনা-কল্পনা চলার পরিপ্রেক্ষিতেই এই সরকারী ঘোষণা প্রচারিত হয়। শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা করে এ কে ব্রোহী রাওয়ালপিন্ডি ফিরে ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করার সাতদিন পরে আজ এই বিচার প্রহসন পুনরায় শুরু হল।
ঢাকায় পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর বলেন, পাক-ভারত যুদ্ধ বাধলে তা বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেবে। ভারত পাকিস্তানের দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনীকে মোকাবেলা করতে পারবে না বলেই পূর্ব পকিস্তানে মুক্তিবাহিনীর নামে পঞ্চম বাহিনী গড়ে তুলেছে। মুক্তিবাহিনী কাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে? দেশতো মুক্ত।
সেনেগালের রাজধানী ডাকার থেকে প্রকাশিত ‘লা সোলেইল’ ‘শরণার্থীদের নিয়ে ভারতের সমস্যা’ শিরোনামের সংবাদ থেকে জানা যায়, ভারত বর্তমানে তার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর নাটক স্ক্রিনিং করছে। ৫০ হাজার শরণার্থী প্রতিদিন তার সীমানার মধ্যে প্রবেশ করছে। বাংলায় ৮ মিলিয়নেরও বেশি লোক রয়েছে। সরকার তাদের খাওয়ানোর জন্য প্রতিদিন ২০ মিলিয়ন রুপি খরচ করছে। তাদের দুর্ভোগের মহাসাগরে এটি একফোঁটা জলকণা মাত্র। এটা পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের ফল।
বাঙালীয়ানা/এসএল