মুক্ত মুজিব: লন্ডনে সংবাদ সম্মেলন

Comments

৮ জানুয়ারী, ১৯৭২ শনিবার
কী ঘটেছিল

৯ মাস ১৩ দিনের কারাবাসের পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু মুক্ত হলেন। পাক হানাদারবাহিনীর লজ্জাজনক পরাজয়, আন্তর্জাতিক চাপে বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ২৩ দিন পর শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হল পাকিস্তান সরকার।
রাওয়ালপিন্ডি থেকে ৭ জানুয়ারী দিবাগত মধ্যরাতে ড. কামাল হোসেন, তাঁর স্ত্রী হামিদা হোসেন ও তাঁদের সন্তানসহ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সরকারের চার্টার করা পিআইএ-র একটি বিশেষ বিমানে লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হন। রাওয়ালপিন্ডির চাকলালা বিমানবন্দরে এসময় উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো।
শেখ মুজিবের মুক্তি ও লন্ডন যাত্রার বিষয়টি পাকিস্তান সরকার অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে সম্পন্ন করে। রাওয়ালপিন্ডি থেকে বিমান উড্ডয়নের ৬ ঘন্টা পরে পাকিস্তান সরকার যুক্তরাজ্য সরকারকে বিমানে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতির তথ্য জানায়।

৭ জানুয়ারী ১৯৭২ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে কি ঘটেছিল 
জানতে পড়ুন

৮ জানুয়ারী গ্রিনিচ সময় সকাল ৬টা ৩৬ মিনিটে অর্থাৎ বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে পিআইএ-র বিমানটি হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করে।
হিথরো বিমানবন্দর ভিআইপি লাউঞ্জে যুক্তরাজ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কমনওয়েলথ বিষয়ক বিভাগের কর্মকর্তা ইয়ান সাদারল্যান্ড, লন্ডনে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার আপা বি পন্থ শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাগত জানান। ইতোমধ্যেই লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনের প্রধানের দায়িত্ব পালনরত রেজাউল করিম উপস্থিত হয়েছেন বিমানবন্দরে। বঙ্গবন্ধু যখন লাউঞ্জে অপেক্ষা করছিলেন, তখন সেখানে আসেন পাকিস্তানের হাইকমিশনার নাসিম আহমেদ।
এরপর বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও লন্ডন গমনের খবর গণমাধ্যম প্রচার করলে দেশের আপামর জনসাধারণ ও বিশ্বনেতৃবৃন্দের চোখ নিবদ্ধ হয় লন্ডনে।
বঙ্গবন্ধু হিথরো বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেও সেখানে কোনও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে বিমানবন্দরে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন আমি সুস্থ আছি, বেঁচে আছি। এ মুহূর্তে আপনারা শুধু আমাকে দেখুন, কিছু শোনার আশা করবেন না। তাই এখন আমি আর বেশি কিছু বলতে চাই না। সম্ভবত পরে একটা বিবৃতি দিতে পারি।’
তিনঘণ্টা বিমানবন্দরে অবস্থানের পর বঙ্গবন্ধু ড. কামাল হোসেনসহ ক্লারিজ হোটেলের উদ্দেশে রওনা হয়। গাড়িতে ওঠার সময় তিনি সামনে বসতে পারেন কিনা জিজ্ঞাসা করলে কর্মকর্তারা বলেন, অবশ্যই।
হোটেলে হাজার হাজার মানুষ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্যে উপস্থিত হতে থাকলে সমস্যার মধ্যে পড়তে হয় হোটেল কর্তৃপক্ষকে। নিরাপত্তার স্বার্থে পাঁচজনের একটি দলকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হয়।
হোটেলে শেখ মুজিবের সাথে দেখা করতে এলেন ব্রিটেনের লেবার পার্টির নেতা হ্যারন্ড উইলসন, কমনওয়েলথের মহাসচিব আরনল্ড স্মিথ, সাবেক মন্ত্রী পিটার শোরসহ আরো অনেকে।
হোটেলের হলরুমে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আজ আমি মুক্তভাবে দেশবাসীর সঙ্গে স্বাধীনতার আনন্দ ভাগ করে নিতে পারছি। এক মহাকাব্যিক সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা এই স্বাধীনতা অর্জন করেছি। … … এই লড়াইয়ের চূড়ান্ত অর্জন হলো একটি স্বাধীন, সার্বভৌম, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ গঠন করা। আমি যখন কারাগারে বন্দী অবস্থায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম, তখন জনগণ আমাকে রাষ্ট্রপতি হিসাবে ঘোষণা করেছে।” তিনি আরও বলেন, “স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের মানুষ যে পরিমাণ মূল্য দিয়েছে এবং কষ্ট ভোগ করেছে, অন্য কোনো জাতিকে তা করতে হয়নি। আমি আমার দেশের মানুষের কাছে ফেরার জন্য আর অপেক্ষা করতে পারছি না।”
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন বঙ্গবন্ধু। পশ্চিম পাকিস্তানে আটক এবং যেকোনো সময় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিষয়ে জানতে চান একজন সংবাদিক। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম। মনে রাখতে হবে, যে মানুষ মরতে প্রস্তুত, তাকে কেউ মেরে ফেলতে পারে না।” অপর এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, আপনি কী কখনো ভেবেছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হবে? জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমি প্রায় ৩৫ বছর ধরে রাজনীতি করছি। যেদিন আমাকে কারাগারে নেওয়া হয় আমি বুঝতে পারছিলাম না বেঁচে থাকব নাকি মরে যাব। তবে, আমি জানতাম বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীন হবে, তাদের কেউ দমাতে পারবে না।”
সন্ধ্যায় ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে যান শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানে তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে শেখ মুজিব বাংলাদেশকে সার্বভৌম দেশ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু কমনওয়েলথের সদস্যপদ প্রত্যাশার কথা জানান ‍ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে এবং প্রধানমন্ত্রী হিথ এ বিষয়ে আশ্বাস প্রদান করেন। একইসঙ্গে তারা বাংলাদেশকে কেন স্বীকৃতি দিতে পারেনি তার কারণও ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ব্রিটেন এবং ভারতীয় উপমহাদেশের তিনটি দেশের মধ্যে মধুর সম্পর্ক রাখতে চাই। আমরা ভুট্টোকে বাস্তবতা মেনে নিতে সাহায্য করব।” হিথ মুজিবের কাছে জানতে চান, ‘আমরা আপনার জন্য আর কী করতে পারি’? জবাবে শেখ মুজিব বলেন, “আপনি আমাদের জন্য একটি কাজ করুন, যত দ্রুত সম্ভব আমাদের বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিমান দিয়ে সাহায্য করুন।”
২৫ মার্চের দুর্বিসহ কালোরাতের পর এদিন হোটেল থেকে প্রথমবারের মতো পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আধঘণ্টা কথা বলেন শেখ মুজিব। প্রথমে বড় ছেলে শেখ কামাল, পরে ক্রমান্বয়ে বেগম মুজিব, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও ছোট ছেলে শেখ জামালের সঙ্গে কথা বলেন। বেগম মুজিব আবেগঘন কণ্ঠে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। পরে বেগম মুজিব সাংবাদিকদের জানান তিনি আবেগে এত অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন যে, প্রথমবার কথা বলতে পারেননি। দ্বিতীয়বার কল আসলে শেখ সাহেব জানতে চান – আমি কেমন আছি। আমি বললাম, ‘আমরা ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন? লন্ডন থেকে প্রথম টেলিফোন কলে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের প্রতি শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম প্রশ্ন ছিল – ‘বেঁচে আছো তো’?
বঙ্গবন্ধু এরপর তাঁর দীর্ঘদিনের সহযোদ্ধা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে যুক্ত হয়ে বলেন, ‘হ্যালো তাজউদ্দীন, আমি সাংবাদিক পরিবৃত আছি, তাদের কী বলবো? দেশের মানুষ কেমন আছে? বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে যে অগণিত নারী-পুরুষ ও শিশু নিহত হয়েছেন, এই মুহূর্তে তাদের কথা আমার জানতে খুব ইচ্ছে করছে’। এসময়ে তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সাথেও কথা বলেন।
এদিনই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বলেন এবং নয়াদিল্লী সফরের আমন্ত্রণ জানান। ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবুর রহমানের কুশল জানতে চেয়ে বলেন, ‘আমরা খুবই খুশি আপনি মুক্তি পেয়েছেন’। শেখ মুজিবুর রহমান ইন্দিরা গান্ধীর মাধ্যমে ভারতের জনগণকে অভিনন্দন জানান। এরপর ইন্দিরা গান্ধী জানতে চান, ‘কেমন আছেন’? জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি ভালো আছি। আমি আপনাদের কাছে খুবই কৃতজ্ঞ’।
বঙ্গবন্ধু লন্ডনে পৌঁছোনোর পর থেকেই তার বাংলাদেশে ফেরার প্রস্তুতি শুরু হয়। কোন পথে কবে দেশে ফিরবেন, এই আলাপের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু লন্ডনেই ঘোষণা দেন— তিনি এক-দুই দিনের ভেতরেই ফিরতে চান।
এদিকে বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা ও স্বাগত জানানোর পরিকল্পনা করতে বঙ্গভবনে মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠক বসে শনিবার। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ভারতের ওপর দিয়ে আসবেন বলে তিনি আশা করছেন। তিনি এসে রমনা রেসকোর্স, শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়’। বৈঠক থেকে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বন্ধু রাষ্ট্রকে ধন্যবাদও জানানো হয়।

অগ্নিঝরা একাত্তরের দিনগুলো, পড়ুন

ডিসেম্বর ১৯৭১

নভেম্বর ১৯৭১

অক্টোবর ১৯৭১

সেপ্টেম্বর ১৯৭১

আগস্ট ১৯৭১

জুলাই ১৯৭১

জুন ১৯৭১

মে ১৯৭১

এপ্রিল ১৯৭১

মার্চ ১৯৭১

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.