কলকাতার “ন হন্যতে” সিনেমাটার কথা মনে আছে? যখন বিল্ডিংটা ভেঙ্গে পরে এবং শিউলী ও রতন নামের দুইটা বাচ্চা ভাই বোন আটকা পরে সেই বিল্ডিং এর একটা কলামের নীচে? এক সময় এলাকার উদ্ধারকারীরা যখন মা জুঁইকে বলে একটা বাচ্চাকে বাঁচান যাবে এবং জানতে চায় কাকে বাঁচাবে তখন মা জুঁই বলে রতনকে বাঁচাতে। শিউলী যে পিলারের নীচে চাপা পরেছিল, বাচ্চাটা ঐ অবস্থাতেই মায়ের কথাটা শুনতে পায়। তার মনে হয় সে মরে গেলেই ভাল ছিল কথাটা শোনার আগে। এরপর শিউলী নিজের চেষ্টাতেই সেখান থেকে বের হয় এবং আর মায়ের কাছে ফিরে যায় না। এ পর্যন্তই থামি।
এবার সিনেমার না, একটা বাস্তব ঘটনা বলি। আমার এক বান্ধবী সর্বস্ব দিয়ে মা ও ছোট বোনকে আগলে রেখেছিল। ঘর সংসার করেনি। যা আয় করেছে তা সংসারেই ব্যয় করেছে। দিনের পর দিন আমি তার কষ্ট করা দেখেছি। অথচ তাদের চার বোনের একটি ভাইও আছে। সেই ভাইকে কোনদিন একটা টাকা দিয়েও পরিবারকে সাহায্য করতে দেখিনি। কিন্তু খালাম্মা যখনই আমাকে বা আমার কোন বান্ধবীকে দেখতেন, সাথে সাথেই তার মেয়ের নামে যত ধরণের খারাপ কথা বলা যায়, সব বলতেন। কতজনার সাথে মেয়েকে শুইয়ে গল্প বলতেন। একদিন আমি আর সহ্য করতে না পেরে ওনাকে কঠিন কিছু কথা শুনিয়েছিলাম।
বাঙ্গালী মায়েদের কাছে বরাবরই পুত্র সন্তানের গুরুত্ব অনেক বেশী। কন্যা সন্তান সর্বস্ব উজাড় করে দিলেও পুত্র সন্তানের সমকক্ষ কখনই হবে না।
একজন নারীকে যখন কোন ভাবেই টলানো যায় না, এ সমাজের লোকজন মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে তার চরিত্র হননের পথটি বেছে নেয়। কারন ঐটাই সহজ। ঐ পর্যন্তই তার চিন্তার দৌড়, এরচেয়ে বেশী কিচ্ছু না। আরও সহজ তাকে একাধিক ব্যক্তির সাথে শুইয়ে দেয়া। এটা পাবলিক খুব ভাল খায়। পাবলিকের রুচি এক্ষেত্রে অসম্ভব ভাল।
মা চরিত্র উপন্যাসে বা সাহিত্যে যেভাবে প্রকাশ করা হয় তারাই শুধু এ সমাজের মা নন। এর বাইরেও আরও মা আছেন যাদের চরিত্র উপন্যাসে নেই।
আমি মা বিশেষজ্ঞ না। তবে গত কয়েকদিন থেকে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজের মায়ের বক্তব্য শুনে উপরে উল্লেখিত মায়েদের সাথে মিল পেয়ে গেলাম। একের পর এক সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানতে পারছিলাম উনি প্রেস কনফারেন্স করে কেঁদেকেটে একাকার হয়ে গেছেন। খুব লজ্জা পাচ্ছিলাম সংবাদগুলো দেখে। দোটানায় ছিলাম। শেষে তুরিন আপার সাথেই সরাসরি যোগাযোগ করলাম। দেখি তুরিন আপা বাকরুদ্ধ। কথা বলতে পারছেন না। এমন অপমানিত বোধ করছেন যে বলার বাইরে। গত কয়েকদিনে তুরিন আপা কয় ঘন্টা ঘুমিয়েছেন আমি হয়তো তার কিছু সময় বলতে পারবো। কারন রাত জেগে জেগে আমরা কথা বলেছি।
আমার ঘরের পেছনে যাদুশিল্পী জুয়েল আইচ থাকেন। তার পেছনের বাড়িতে তুরিন আপারা। আমরা প্রায় ২০ বছর প্রতিবেশী। আম্মার সাথে তুরিন আপার, খালাম্মার ও খালুর খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। আমরা একই সাথে ৩ নম্বর সেক্টর কল্যান সমিতির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাই, খাই, গল্প করি। তুরিন আপাকে যতটুকু দেখেছি, খুব আন্তরিক একজন মানুষ। সাহসী একজন মানুষ। খালুকে শুধু তুরিন আপা প্রসঙ্গে কথা তুলে দিলে হত, এতো আনন্দ নিয়ে উনি মেয়ের গল্প করতেন, দেখতে ভাল লাগত। আমি কোনদিন ওনার ভাই শিশিরকে নিয়ে খালুর কাছ থেকে কোন গল্প শুনিনি।
তুরিন আপা এদেশে যুদ্ধাপরাধীদের জন্য গঠিত ট্রাইবুনালের প্রসিকিউটর হওয়ার পর থেকে ওনার ওপর নানান ধরণের চাপ সৃষ্টি করেছে বিভিন্ন মহল। চাপের পর চাপ। এই চাপগুলো এই হুমকিগুলো উনি সাহসের সাথে মোকাবেলা করে গেছেন এবং যাচ্ছেন দিনের পর দিন। কিন্তু একজন ব্যক্তির পরিবারই যখন তার বিরুদ্ধে লেগে যায়, তখন সেই ব্যক্তির পায়ের তলের মাটিও সরে যায়। পরিবারের ভেতরে যুদ্ধ করা যায় না। কিন্তু ওনার একমাত্র ভাই শিশির সেই সুযোগটিকেই কাজে লাগিয়েছেন। জীবনে তেমন কিছুই হতে পারেনি শিশির। এক সময় বাড়ির সামনে বিশাল একটা সাইনবোর্ড ছিল, কানাডা চলে যাওয়াতে সেটা আর নেই। একসময় বিটিভিতে শিশু শিল্পী হিসেবে অভিনয় করতো, তারপর বড় হওয়ার পর বিটিভিতেই ইংরেজি সংবাদ পাঠ করতো। ঐ পর্যন্তই। কিন্তু দিনে দিনে বোন আকাশ ছুঁয়ে ফেলায় তার male ego সম্ভবত খুব আহত হয়েছে। সে এবং খালাম্মা যে প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য চাইলেন তা দেখে খুব হতাশ বোধ করেছি যে একটা পারিবারিক কলহ নিরসনে একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে হস্তক্ষেপ করতে হবে? একজন রাষ্ট্রপ্রধান তা করবেন? এই লোকের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েই আমার সন্দেহ হয়েছে। আর প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার বা তার মায়ের পরিচয়টা কি? পরিচয় একটাই, তারা ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজের মা ও ভাই। এর বাইরে নিজেদের পরিচয় দেয়ার মত পরিচয় তাদের আর হয়নি।
পরিবারের একজন সদস্যকে এভাবে জনসম্মুখে নোংরা ভাবে উপস্থাপনের জন্য আমি বার বার আহত হয়েছি, লজ্জা পেয়েছি। মনে হয়েছে এরকম পরিবার না থাকলে কি হয়? খালাম্মা এবং খালুর সাথে দেখা হলে যে উচ্ছ্বসিত ভাবে কথা বলতাম, এই মানুষগুলোকে চিনতাম, মনে হচ্ছে শুধু দেখেছি। মা হিসেবে একজন পুত্রসন্তানের মা হিসেবে দেখিনি। একটা কিচ্ছু না হতে পারা ছেলের মা হওয়ার মনে হয় অনেক জ্বালা। শুধু তাই না, এনাদের উস্কানি দাতা যে একটি বিশেষ মহল, যাদের কাছে তুরিন আফরোজ একটি দুঃস্বপ্নের নাম সেটাও আর নিশ্চই বলার অপেক্ষা রাখে না।
তুরিন আপা কয়েকদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবেন আশা করি এবং সর্ব শক্তি দিয়ে এই মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন তাও জানি। যখন আইনগত ভাবে এবং সত্যের পথে থেকে লড়াই করে হেরে যাবার সম্ভাবনা থাকে, তখনই মানুষ মিথ্যাচারের আশ্রয় নেয়। তবে সত্য ধ্রুব। সত্য সূর্য। তাকে চাইলেও আটকানো যাবে না।
পাশে আছি তুরিন আপা । অনেক অনেক ভালোবাসা ও শুভকামনা। এ লড়াইটাতেও আপনারই জয় হবে দেখবেন।
লেখক পরিচিতি:
আতিকা রোমা, মানবাধিকার এক্টিভিষ্ট