এক.
সর্ববৃহৎ সেক্টর ১১ নাম্বার সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের ব্রিফিং চলছে, একজন শীর্ণদেহ মেজর, কিছুদিন হয় পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছেন। এখন ১১ নাম্বার সেক্টরের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে বললেন; “কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে তার খাসী আর মুরগী খেয়ে গেরিলা যুদ্ধ হয় না। যদি কোন কৃষকের গোয়ালে রাত কাটাও, সকালে গোবরটা পরিষ্কার কোরো। যে দিন অপারেশন না থাকে তোমার আশ্রয়দাতাকে একটা Deep Trench Latreen তৈরি করে দিও। তাদের সঙ্গে ধান কাটো, ক্ষেত নিড়াও।”
দুই.
ডিসেম্বরের শেষ দিকে. বিজয়ের আর মাত্র অল্প কয়টা দিন সেই সেক্টর কমান্ডারের বাঁ পায়ে গুলি লেগেছে, রক্ত ঝরছে বিরামহীন; চেষ্টা করেও থামানো যাচ্ছে না। তাঁকে উদ্ধার করতে মিত্র বাহিনীর সদস্যরা দ্রুত হেলিকপ্টার নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌছলো। উদ্ধারকারী মিত্র বাহিনীর অফিসারকে সেই সেক্টর কমান্ডার হা হা করে হাসতে হাসতে বললেন: ‘এরা কী যুদ্ধ করবে,এরা আমার মাথায়ই গুলি লাগাতে পারেনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই, এরা আটকাতে পারবে না, এদের এই ক্ষমতাই নাই’।
তিন.
কর্নেল তাহেরকে জানানো হয়, আজ তাঁর মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর হবে। তিনি সে সংবাদ গ্রহণ করেন এবং সংবাদবাহকদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তারপর সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় তিনি তাঁর খাবার শেষ করেন। পরে একজন মৌলভি তাঁকে তাঁর পাপের জন্য ক্ষমা চাইতে বলেন। তাহের বললেন, …’তোমাদের সমাজের পাপাচার আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি। আমি কখনো কোনো পাপকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। আমি নিষ্পাপ। তুমি এখন যেতে পারো, আমি ঘুমাবো।’ তিনি একেবারে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে গেলেন। রাত ৩টার দিকে তাঁকে জাগানো হলো। সময় জেনে নিয়ে তিনি দাঁত মাজলেন। তারপর শেভ করে গোসল করলেন। উপস্থিত সবাই তাঁর সাহায্যে এগিয়ে এলে তিনি বললেন, ‘আমি আমার পবিত্র শরীরে তোমাদের হাত লাগাতে চাই না।’ তিনি নিজেই তাঁর কৃত্রিম পা খানি লাগিয়ে প্যান্ট-জুতা পরে নিলেন। চমৎকার একটা শার্ট পরলেন। ঘড়িটি হাতে দিয়ে মাথার চুল আঁচড়ে নিলেন। তারপর উপস্থিত সবার সামনে আম খেলেন, চা খেলেন এবং সিগারেট টানলেন। সবাইকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন- ‘তোমরা এমন মনমরা হয়ে পড়েছো কেন? মৃত্যুর চেহারায় আমি হাসি ফোটাতে চেয়েছিলাম। মৃত্যু আমাকে পরাভূত করতে পারে না।’ তাঁর কোনো ইচ্ছা আছে কি না জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন- ‘আমার মৃত্যুর বদলে আমি সাধারণ মানুষের শান্তি কামনা করছি।’ এরপর ফাঁসির মঞ্চে আবৃত্তি করেন সেই কবিতা- ‘জন্মেছি, সারা দেশটাকে কাঁপিয়ে তুলতে কাঁপিয়ে দিলাম। জন্মেছি, তোদের শোষণের হাত দুটো ভাঙ্গব বলে ভেঙ্গে দিলাম। জন্মেছি, মৃত্যুকে পরাজিত করব বলে করেই গেলাম। জন্ম আর মৃত্যুর দুটি বিশাল পাথর রেখে গেলাম। পাথরের নিচে, শোষক আর শাসকের কবর দিলাম। পৃথিবী অবশেষে এবারের মতো বিদায় নিলাম…’ এরপর, একজন কর্নেল তাহের; পৃথিবীর সমান বয়সী স্বপ্ন নিয়ে আলিঙ্গন করেন ফাঁসির রজ্জু…
চার.
একবার জল্লাদ সিরাজউদ্দিনের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছিলো মিনার মাহমুদের বিচিন্তা পত্রিকায়। সেই সাক্ষাৎকারের কিছু চুম্বক অংশ পাঠকদের উদ্দেশ্যে: প্রশ্ন: ফাঁসির মঞ্চের কোনও ব্যক্তির আচরণ কি আপনার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে? যদি যায়, তবে সেই ব্যক্তিটি কে? জল্লাদ সিরাজউদ্দিন: কর্নেল তাহের। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়াইয়া তিনি সহজভাবে কথা বলেছেন। একটা বিপ্লবী কবিতা পইড়া শোনাইছেন। আশ্চর্য! তিনি নিজের হাতে যমটুপি পরছেন। নিজেই ফাঁসির দড়ি নিজের গলায় লাগাইছেন। আমার মনে হয় ফাঁসির মঞ্চে এমন সাহস- দুনিয়ার আর কেউ দেখাইতে পারে নাই…
পাঁচ.
মানুষকে অনেকের অনেক কথাই নাড়া দেয়। তেমনি আমার চিন্তার জগতকে ওলটপালট করে দেয় কর্নেল তাহেরের একটা উক্তি: “নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে জীবনে আর কোনো বড় সম্পদ নেই। আমি তার অধিকারী। আমি আমার জাতিকে তা অর্জন করতে ডাক দিয়ে যাই।” তাহের মরেনি তাহেররা কখনো মরে না। আমার সাথে তাহেরের দেখা হয় কানসাটে -ফুলবাড়িতে- ভবদহে- নারায়ণগঞ্জে-সাভারে-শাহবাগে-পরিবাগে কিংবা অন্য কোথাও। আজ তাহেরের ফাঁসি দিবস, শ্রদ্ধা আর সম্মানের সাথে স্মরণ করছি তাঁকে।