স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল! একটি নাম, একটি বিস্ময়। অদম্য, দুর্দমনীয়, অজেয় অর্থাৎ একটি Invictus ফুটবল দল। গড়ল এক অনন্য ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে, বিশ্বের ইতিহাসে। রাইফেল, বেয়নেট, ষ্টেনগান, গ্রেনেড কিম্বা মাইক্রোফোন-ইথার শুধু নয়, একটা জাতির দামাল ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে আরেকটি হাতিয়ার তুলে নিল, ফুটবল! এই মুক্তিযোদ্ধারা ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ গঠন করে ভারতের মাটিতে একের পর এক ম্যাচ খেলল। শুরু হলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে অর্থ সংগ্রহে আরেক যুদ্ধ।
শরণার্থী হয়ে বিদেশের মাটিতে একটি ফুটবল দল গড়ে তুলে বিভিন্ন স্থানে ম্যাচ খেলাটা মোটেও সহজ ছিল না। স্বীকৃতিহীন একটি দেশের পক্ষে চাইলেও কোনো ফুটবল ম্যাচ খেলা সম্ভব না। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ফুটবলার ও ছাত্রনেতা সাইদুর রহমান প্যাটেল, ফুটবলার আলী ইমাম, আওয়ামী লীগের নেতা মো. সামছুল হক এমএনএ, লুৎফর রহমান প্রমুখ।
১৯৭১ সালের ১৩ জুন বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় কলকাতায় গঠন করা হলো বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি। সামছুল হককে সভাপতি ও লুৎফর রহমানকে সম্পাদক করে গঠিত কমিটির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ১. স্বাধীনতার সপক্ষে বিশ্ব জনমত গড়া, ২. তহবিল সংগ্রহ ও ৩. পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখাতে পাকিস্তান সরকার ঢাকায় কোনো টুর্নামেন্ট যেন আয়োজন না করতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাড়িয়ে দেন সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত। এ জন্য তুলে দেন ১৪ হাজার রুপি। প্রথমে ফুটবল দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও পর্যায়ক্রমে অন্যান্য খেলা আয়োজনেরও পরিকল্পনা ছিল। অনেক দেনদরবারের পর পাওয়া যায় ভারত সরকারের অনুমোদনও।কলকাতা এবং ইন্ডিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের অনুমোদন লাভ করলো। অনুশীলনের জন্য পার্কসার্কাস মাঠ এবং ফুটবলারদের থাকা-খাওয়ার জন্যে পাওয়া গেল কারনানি এস্টেট বিল্ডিংয়ে (কোকাকোলা ম্যানশন)।.
অল ইন্ডিয়া রেডিও ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে থাকা ফুটবলারদের ট্রায়ালের জন্য কলকাতায় শরণার্থী শিবিরের আসার আহ্বান জানালো। দল গঠনের কথা জানতে পেরে অনেকেই ছুটে এলেন। ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের ফুটবলারদের মধ্য থেকে প্রাথমিক বাছাই ক্যাম্পের মাধ্যমে দল গঠন হয়ে গেল।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে যুক্ত হলেন, জাকারিয়া পিন্টু (অধিনায়ক), প্রতাপ শংকর হাজরা (সহ-অধিনায়ক), নওশেরুজ্জামান, আইনুল হক, খোন্দকার নুরুন্নবী, তসলিমউদ্দিন শেখ, আলী ইমাম, মোহাম্মদ কায়কোবাদ, অমলেশ সেন, শেখ আশরাফ আলী, বিমল কর, শাহজাহান আলম, এনায়েতুর রহমান খান, কাজী সালাউদ্দিন, সুভাষ চন্দ্র সাহা, মনসুর আলী লালু, ফজলে সাদাইন খোকন, আবদুল হাকিম, আমিনুল ইসলাম সুরুজ, আবদুল মোমিন জোয়ার্দার, মনিরুজ্জামান পেয়ারা, আবদুস সাত্তার, প্রাণগোবিন্দ কুণ্ডু, মুজিবর রহমান, লুৎফর রহমান, অনিরুদ্ধ চট্টোপাধ্যায়, সনজিৎ কুমার দে, মামুনুর রশীদ, সাইদুর রহমান প্যাটেল, দেওয়ান সিরাজউদ্দিন সিরু, নিহারকান্তি দাস, বীরেন দাস বীরু, আবদুল খালেক ও মোজ্জামেল হক। দলের কোচ ননী বসাক আর ম্যানেজার ছিলেন তানভীর মাজহারুল ইসলাম তান্না।
২৫ জুলাই, কৃষ্ণনগরের নদীয়া স্টেডিয়াম, নদীয়া জেলা একাদশ প্রতিপক্ষ। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের প্রথম ম্যাচ। পূর্ব বাংলা থেকে শীর্ষ ফুটবলারদের নিয়ে গড়া দল তাদের স্বাধীনতার প্রশ্নে জনমত গঠনের জন্য ম্যাচ খেলবে—এমন ঘোষণায় সেদিন দুপুর থেকেই স্টেডিয়াম ছিল লোকে লোকারণ্য। বিকেল পাঁচটায় ম্যাচ শুরু হওয়ার কথা।
কিন্তু বেশ বড় ধরনের একটা সমস্যা খেলাটিকে ফেলে দিল অনিশ্চয়তার মধ্যে। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়েরা জানালেন, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে, জাতীয় সংগীত গেয়েই মাঠে খেলতে নামবেন। ভারত তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে ম্যাচটির আয়োজক নদীয়া জেলা প্রশাসন পড়ে গেল দ্বিধায়। এভাবে স্বীকৃতি না-পাওয়া একটি দেশ অন্য আরেকটি দেশে জাতীয় পতাকা ওড়ালে সেটির আইনগত ঝামেলা আছে।
জেলা প্রশাসক দীপক কান্তি ঘোষ যেন ভেবে পাচ্ছিলেন না কী করা। এ দিকে ম্যাচ শুরুর তাগাদা দিচ্ছে গ্যালারির হাজারো জনতা, অন্য দিকে পতাকা ওড়ানোর দাবিতে অনড় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। রাষ্ট্রীয় আচার লঙ্ঘনের ঝুঁকিতে দাঁড়িয়ে জেলা প্রশাসকও। তবে দীপক নিজে বাঙালী। আর তখন গোটা বাঙালী জাতিই ছিল আবেগের তুঙ্গে।
শেষ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা দলের খেলোয়াড়দের আবেগের কাছেই পরাজিত হলেন জেলা প্রশাসক, পরাজিত হলেন নিজের আন্তরিক আবেগের কাছেও। অনুমতি দিলেন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা তোলার। সেই সঙ্গে জাতীয় সংগীত বাজানোর। স্বীকৃত দেশ না হয়েও ভারতের মাটিতে ভারতের জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতের সঙ্গে বাংলাদেশের ‘আমার সোনার বাংলা’ আবেগে কাঁপিয়ে দিল গোটা কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামকেই। হানাদারকে আক্রমণে বিধ্বস্ত রক্তাক্ত সবুজ দেশের কথা ভেবে শুধু ফুটবলারদের নয় প্রতিবেশী দেশের অসংখ্য মানুষ সেদিন গ্যালারীতেও চোখের জলে ভেসেছিলেন।

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সাথে শুভেচ্ছা-পতাকা বিনিময় করছেন নদীয়া একাদশের খেলোয়াড়রা।
তবে ভারত সরকার এ কারণে নদীয়া জেলা প্রশাসনের উপর অসন্তুষ্ট হয়েছিল এবং নদিয়া জেলা প্রশাসক দীপক কান্তি ঘোষকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল। এমনকি নদিয়াকেও ভারতীয় ফুটবল এসোসিয়েশন থেকে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হইয়েছিল।
যে মানচিত্র খচিত লাল-সবুজ পতাকার জন্যে মুক্তিযোদ্ধারা রণাঙ্গনে বুকের রক্ত ঢেলে দিচ্ছে সেই পতাকার জন্যই পিন্টু-প্রতাপরা নিজের সবটুকু উজাড় করে দেন সবুজ মাঠে। নদীয়া জেলা একাদশের বিপক্ষের ঐতিহাসিক ম্যাচটি ড্র হয়েছিল ২-২ গোলে। স্বাধীন বাংলা দলের হয়ে প্রথম গোল করেন শাহজাহান ও এনায়েত।
এ ঘটনা যুদ্ধরত বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ভারত এবং ইংল্যান্ডের সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।
দলের সব ফুটবলার শেষ পর্যন্ত মাঠের যুদ্ধে ছিলেন না, প্যাটেলসহ অনেকে রণাঙ্গনের যুদ্ধে চলে গেছিলেন। বাংলাদেশের পরবর্তী ম্যাচ ছিল দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সেরা ফুটবল দল কলকাতার মোহন বাগানের বিপক্ষে। কিন্তু আগের ম্যাচের বিতর্কের কারণে মোহন বাগান নাম পাল্টে গোষ্ঠ পাল (গোষ্ঠ পাল ছিলেন কিংবদন্তি ভারতীয় ফুটবলার) একাদশের ব্যানারে খেলতে রাজি হয়েছিল। ৮ আগস্ট মোহনবাগান মাঠে গোষ্ঠপাল একাদশের কাছে ৪-২ গোলে হেরেছিল স্বাধীন বাংলা দল। তারপরও গোষ্ঠপাল একাদশের ক্যাপ্টেন চুনি গোস্বামী বাংলাদেশের ভূয়সী প্রসংশা করেছিলেন।
১৪ আগস্ট রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে দক্ষিণ কলকাতা স্পোর্টিং ফেডারেশন একাদশের বিপক্ষে ৪-২ গোলে জিতেছিল। এ খেলা শুরুর আগে বাংলাদেশী ফুটবলাররা পাকিস্তানের পতাকা পদদলিত করে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই ঘটনায় ভারত সরকার বিব্রত হয়।
নরেন্দ্রপুরে চতুর্থ ম্যাচেও জয় পায়। বিহারে মুজাফফরপুরের কাছে হারলেও, সিয়ান ও পূর্ণিয়ায় জয় ছিল। বেনারস মেয়র একাদশ এবং মুম্বাই কুপারেজ স্টেডিয়ামে মুম্বাই স্পোর্টস উইক একাদশের সাথে শেষ ম্যাচ খেলে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।
ইতিহাসবিদ ও লেখক কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, সর্বাধিক মনোযোগ আকর্ষণকারী ম্যাচটি ছিল মুম্বাইতে স্পোর্টস উইক একাদশের বিপক্ষে। স্পোর্টস উইকের সম্পাদক খালিদ আনসারী ম্যাচটি আয়োজনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন। ড্যাশিং ক্রিকেটার মনসুর আলী খান পতৌদি ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব করেন এবং স্পোর্টস উইকের হয়ে একমাত্র গোলটি করেন। ম্যাচটিতে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ৩-১ গোলে জয়লাভ করে। পরে পতৌদি, মুম্বাই গভর্নর এবং বলিউড তারকা দিলীপ কুমার বাংলাদেশের ত্রাণ তহবিলে বিপুল অর্থ দান করে।
বাংলাদেশ একাদশ দিল্লীতে আরেকটি ম্যাচ খেলতে যাওয়ার কথা, এমন সময় বহুল প্রতীক্ষিত সংবাদটি আসে, বাংলাদেশ পাকিস্তানি হানাদারদের কবলমুক্ত একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। এতে সবাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে। শেষ ম্যাচটি আর মাঠে গড়ায় না।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে জাকারিয়া পিন্টু ১০টি এবং আইনুল হক ৩টি ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেন। সর্বমোট ১৩ ম্যাচ খেলে বিপুল সারা জাগানোর পাশাপাশি প্রায় ৫ লক্ষ রুপির তহবিল সংগ্রহ করে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল যা বাংলাদেশ সরকারের তহবিলে জমা করা হয়।
কোনো দেশের মুক্তিসংগ্রামে ফুটবল খেলা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, সেদিনের আগে বিশ্ববাসীর তা জানা ছিল না।
বাঙালীয়ানা/এসএল