১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় নরঘাতক পাকসেনাদের দ্বারা বিভিন্ন পরিকল্পিত গণহত্যা পরিচালিত হয়েছে। একাত্তরের এইসব গণহত্যাগুলো বিংশ্ব শতাব্দির কুখ্যাত ইহুদীদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, ভিয়েতনামে মার্কিনের দ্বারা গণহত্যা কিংবা রুয়ান্ডায় সংঘটিত গণহত্যার সমান। জানোয়ার পাকসেনারা যে কত হিংস্র হয়ে বাংলার স্বাধীনতাকামী নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে তা একজন পাকসেনার স্বীকার উক্তি থেকে পাওয়া যায়।
“…we were told to kill hindus and kafirs (non-believers in God). One day in June, we cordoned a village and were ordered to kill the kafirs in that area. We found all the women reciting from the Holy Quran and the men holding special congregational prayers seeking God’s mercy. But they were unlucky. Our commanding officer ordered us not to waste any time”.( confession of a Pakistani Soldier)।
জানোয়ার পাকসেনারা বাংলার যে সব জায়গায় গণহত্যা করেছে ঢাকার কাছে কেরানীগঞ্জের গণহত্যাটি অন্যতম । কেরানীগঞ্জ বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে অবস্সিত। ১৯৭১ সালের ২রা এপ্রিল শুক্রবার ভোরে থেকে শুরু হওয়া নয় ঘণ্টার রোমহর্ষক গণহত্যাটি সংঘটিত হয় কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা, শুভাড্যা ও কালিন্দী তিনটি ইউনিয়নে। ঢাকার আশে পাশের এলাকার মধ্যে জানোয়ার পাকসেনারা সে সব সিসটেমেটিক গণহত্যা করেছে, জিঞ্জিরার গণহত্যাটিই প্রথম। পাক জানোয়াররা এই পরিকল্পিত অপারেশনটি কেরানীগঞ্জে পরিচালনা করে বিভিন্ন কারণে। এই এলাকাটির অধিকাংশ বাসিন্দা ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। আওয়ামীলীগের শক্ত ঘাটি হিসাবেও এর পরিচিতি ছিল। তাছাড়া ঢাকাতে ২৫ শে মার্চের অপারেশন সার্চ লাইটে পাকসেনাদের তাড়া খেয়ে বহু আশ্রয়হীন মানুষ এই এলাকায় গিয়েছিল নিরাপদে থাকার জন্য। বিশেষ করে আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের বহু নেতাকর্মী কেরানীগঞ্জ থেকে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল বলে পাকসেনারা জানতে পারে। ২৬ মার্চেই কেরানীগঞ্জের থানার সব অবাঙ্গালী পুলিশদের হত্যা করে অস্ত্র লুট করে আওয়ামী-ছাত্রলীগের নেতা ও কর্মীরা। তাই এরা পাকসেনাদের কাছে দুস্ষ্কৃতকারী হিসাবেই চিহ্নিত ছিল। এই কেরানীগঞ্জ দিয়েই তাজউদ্দীন আহমদ সহ আওয়ামীলীগের প্রথম সারির নেতারা ঢাকা থেকে ভারতে গিয়েছিলেন।
নৃশংস গণহত্যাটি শুরু হয় শুক্রবার ভোর রাতে। এই বারটি বেছে নেওয়ার একটি বিশ্লেষণ পাওয়া যায় নির্মলেন্দু গুণের “আত্নকথা ১৯৭১’ বইয়ে। গুণ লিখেছেন সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্টের নীতিনির্ধারকরা যুদ্ধে নিয়োজিত সকল পাকসেনাদের ধারণা দিয়েছিল যে যাদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ তারা সবাই মালাউন, ভারতের চর। এই ভারতের চররা ইসলাম ও পাকিস্তানের শত্রু। তাই এইসব মালাউনদের হত্যা করা জন্য শুক্রবারই ভাল দিন।
কেরানীগঞ্জের মানুষ তখনও ঘুমে অচেতন এবং তাদের ঘুম ভাঙ্গে পাকসেনাদের মর্টার শেল ও মেশিনগানের শব্দে। এর আগে ১লা এপ্রিল বিকালে বুড়িগঙ্গার উপর গানবোট নিয়ে পাকসেনারা টহল দিয়েছিল । কেরানীগঞ্জের জনগণ পাক জানোয়ারদের টহলের সংবাদ পেলেও তারা বুঝতে পারে নাই যে এই টহলটি দেয়া হচ্ছে তাদের কে হত্যা করার জন্য । পাক পশুরা বাংলার নিরীহ জনগণকে হত্যার প্রস্তুতি নিচ্ছিল রাতভর ধরে। কেরানীগঞ্জকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছিল যেন কোন লোক পালিয়ে যেতে না পারে। এই হত্যাযজ্ঞটি পরিচালনা করে কুখ্যাত পাক ব্রিগেডিয়ার রশিদ ( দৈনিক বাংলা,৩ এপ্রিল ১৭৭২)। মিটফোর্ড হাসপাতাল ও এর পার্শ্ববর্তী মসজিদের ছাদের উপর থেকে পাকসেনা অফিসাররা এই পরিকল্পিত নরহত্যাকে পরিচালনা ও পর্যবেক্ষণ করে । উল্লেখ্য যে মসজিদের উপর থেকে ফায়ার করে গনহত্যার শুরু করার জন্য সিগনাল দেওয়া হয়েছিল।
কেরানীগঞ্জে পৌঁছেই পাকসেনারা প্রথমে জিঞ্জিরা ও বড়িশুর বাজা্রে গান পাউডার ছিটিয়ে আগুনে পুড়িয়ে দিল। মানুষ যে যে দিকে পারে , দিগ্বিদিক হয়ে ছুটছে প্রাণের ভয়ে। মানুষ যে যেখানে পারে আত্বগোপন করে। জানোয়ার পাকসেনারা চারদিক থেকে নির্বিচারে হিংস্র বাঘের মত যাকেই সামনে পেল থাকেই হত্যা করল। কেউ রেহাই পাইনি এই দিন, এমনকি মায়ের কোলের শিশু । পুড়িয়ে দেওয়া হল গ্রামের পর গ্রাম । তুলে নেওয়া হল কলেজে পড়ুয়া অনেক মেয়েদেরকে । সবচেয়ে অমানবিক ঘটনাটি ঘটে মান্দাইল ডাকের পুকুরের পারে। ষাট জন নিরপরাধ মানুষকে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করা হয়। পাশবিক অত্যাচার করে এগার জন মহিলাকে হত্যা করা হয় কালিন্দ গ্রামের এক বাড়িতে ( দৈনিক বাংলা, ১ নভেম্বর ১৯৭২)। পুরো কেরানীগঞ্জ এলাকায় মৃত মানুষের দেহ রাস্তায়, ঝোপঝাড়ে, পুকুর পাড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল । এই নয় ঘণ্টার পাশবিক গণহত্যায় এক হাজারের বেশী নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
এই গণহত্যার বিষয়টি পাকিস্তান টেলিভিশনে ২রা এপ্রিল প্রচার করে। বলা হয়, যে সব বিছিন্নদাবাদী, দুস্ষ্কৃতকারী কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় আশয় নিয়েছিল পাক সেনাবাহিনী তাদের উপর সামরিক একশান নিয়েছে । ৩রা এপ্রিল মর্নিং সান পত্রিকায় এই গণহত্যা কে নগ্ন সমর্থন দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছিল। উল্লেখ করা হয়েছিল যে এই সামরিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে কেরানীগঞ্জকে মুক্ত করা হল দুষ্কৃতকারীদের হাত থেকে।
কবি নির্মলেন্দু গুনের লেখায় ফুটে উঠেছিল সেদিনের সেই নৃশংস হত্যাকান্ডের বর্ণনা:
“একটি ডোবার ভেতরে মাথা গুঁজে বসে আমি তখন এমন একটি করুণ মৃত্যুর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করি যা আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না। পারি নি। আমি দেখি, শেলের আঘাতে একজন ধাবমান মানুষের দেহ থেকে তার মস্তকটি বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিটকে পড়েছে আমি যে ডোবায় লুকিয়ে ছিলাম সেই ডোবার জলে, কিন্তু ঐ মানুষটি তারপরও দৌড়াচ্ছে। শেলের আঘাতে তার মাথাটি যে দেহ থেকে উড়ে গেছে, সেদিকে তার খেয়ালই নেই। মস্তকছিন্ন দেহটিকে নিয়ে কিছুটা দূরত্ব অতিক্রম করার পর লোকটা আর পারলো না, তার কবন্ধ দেহটা লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। মস্তকহীন দেহ থেকে ফিনকি দিয়ে ছোটা রক্তস্রোতে ভিজে গেল শুভাড্যার মাটি।”
তথ্যসূত্রঃ
১) কালেরকন্ঠ
২) জিঞ্জিরা জেনোসাইড ১৯৭১ – নির্মলেন্দু গুণ