।। রফি হক ।।
১.
আজকাল লালনকে নিয়ে চারপাশে হইহই হচ্ছে দেখি। আমার জন্ম কুষ্টিয়াতে, ছেঁউরিয়ার খুব পাশেই আমাদের বাড়ি। তারেচে বড় কথা আমি শিশুকাল থেকে বড়ই হয়েছি ছেঁউড়িয়ার ফকিরদের সান্নিধ্যে। আমার নানা বাড়ি যে অঞ্চলে সেই গ্রামের নাম কালোয়া। কুষ্টিয়ার গড়াই নদী পার হলে কয়া, কালোয়া, শিলাইদহ, ছেঁউরিয়া –এসব গা ঘেঁষাঘেঁষি গ্রাম। এ এলাকাগুলি ফকির সম্প্রদায়ের বসবাসকারী অঞ্চল। এরা তাঁতী সম্প্রদায়ের। এ অঞ্চলের মানুষেরা জন্ম থেকেই দেহতত্ব গানের ভাবাদর্শে বড় হয়। এটা রবীন্দ্রনাথের জমিদারী এলাকা। আশচর্য্যজনকভাবে এই এলাকা জুড়ে ছিল চার মহান পুরুষের বাস। লালন, রবীন্দ্রনাথ, কাঙ্গাল হরিনাথ এবং মীর মোশাররফ হোসেন।
২.
আমি যখন শিশুকালে বা কৈশোরে বিখ্যাত কুষ্টিয়া মোহিনী মিলের প্রান্তে ছেঁউরিয়াতে লালন মাজারে গিয়েছি, সেটা ছিল একটা নিতান্তই নির্জন জায়গা। নি:সঙ্গ জায়গা বললেও ভুল হবে না। খুব কৌতুহলী না হলে কুষ্টিয়ার শহরবাসীরাও সেদিকে খুব একটা যেতেন না। যদি বলি যেতেনই না, তাহলেও বেশি বলা হবে না। লালন তখনও আজকের মতো আইকনে পরিণত হননি। যেহেতু ছেঁউড়িয়া রবীন্দ্রনাথের জমিদারী এলাকা স্বভাবতই ঠাকুরবাড়ির দৃষ্টি তাঁর ওপর পড়েছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর স্কেচ আঁকেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের খাতা সংগ্রহ করে তাঁর গানগুলি সংগ্রহ করে ছেপেছিলেন প্রবাসী পত্রিকায়।
৩.
লালনকে নিয়ে অনেক অনেক মিথ আছে। কিন্তু বস্তুত, তাঁর জীবন সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। সমাজ বিজ্ঞানবিষয়ক যে গবেষণা, তাতে খোঁজ করে পাওয়া যায়নি তাঁর বিজ্ঞানসম্মত কিছুই, বাড়ি জমি দাখিলা, দস্তাবেজ কিছুই পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন
কেন লালনকে চাই
তাঁর মৃত্যুকালটি নি:সন্দেহে ১৮৯০। কিন্তু তাঁর জন্মসাল ১৭৭৪ সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসুত। যে অসাম্প্রদায়িক ও মানবতার কথা আছে তাঁর রচনার মধ্যে, সেটা তাঁকে মহত্ব দিয়েছে সঙ্গতভাবে। লালন নি:সন্দেহে একজন মহান কবি, তিনি যত বড় সাধক তারচেয়ে বেশি একজন স্রষ্টা। লালনকে বুঝতে হলে তাঁর লেখা গভীরভাবে বুঝতে হবে। আজকাল লালন বোঝাবুঝির বাইরে চলে গেছেন নানা ধরণের মিথের অতিশায্যে লালন এক বাণিজ্যিক উপকরণে পরিণত হয়েছে। তাঁকে বাউল সম্রাট বানানো হয়েছে। অনেক বড় বড় নামের গবেষক তাঁকে বাউল বানানোর চেষ্টা করেছেন, সফলও হয়েছেন। এটা ভুল, আমি তাই মনে করি। বাউল শব্দটিই তাঁর গানে কোথাও পাবেন না! আমাদের সংসারের মাপকাঠি দিয়ে তাঁকে বিচার করতে গেলে মস্ত ভুল হবে। তিনি ছিলেন সব কিছুর ঊর্ধ্বে একজন ধর্ম নিরপেক্ষ মানুষ।
৪.
লালন ছিলেন একজন ফকির। লালন এক আচরণবাদী মারফতি ফকির। আবারও বলি বাউল আর ফকিরদের একই ব্রাকেটের মধ্যে নিয়ে আসা অন্যায়। বাউলদের মধ্যে রোমান্টিক ব্যাপারটি আছে। ফকিরদের মধ্যে তা নেই। আমাদের জীবন যাপনের মধ্যে মুক্তির যে আকাঙ্ক্ষা আছে, তা ওদের মধ্যে চিরকালের। ওদের যে পারমিসিভ সোসাইটি, একসঙ্গে থাকছে কিন্তু বিয়ের বন্ধনে ঢুকছে না। এটা আমাদের অনেককে আকৃষ্ট করে বটে, কিন্তু সেটা আমরা চেষ্টা করেও পারি না।
৫.
আমি যে ফকিরদের দেখেছি। তাঁরা নিতান্তই দরিদ্র। রান্নার উপকরণ অতি সামান্য। নগণ্যও। ভিক্ষে মাগা মুঠো চালের ভাত, কাঁচা মরিচ, মাছ মাসে এক আধ দিন। তেলও ছিল না রান্নার ব্যবহারে। দরিদ্র মানে যা বুঝি তা নয়। ফকির মানেও যা সাধারণে বুঝি তা নয়। কঠিন কৃচ্ছতার জীবনই ওদের জীবনযাপনের অংশ। ওরা কিন্তু পারফর্মার না। আমরা যে ওদের মঞ্চে তুলে দিচ্ছি এটা গর্হিত অপরাধ। প্রকৃত আচরণবাদী মারফতি ফকিরকে মঞ্চে তোলা যায় না। আজকাল লালন উৎসবের নামে যা হয়, তাও গর্হিত অপরাধ। নকল ফকির বেশধারী বাউল মঞ্চে পোজ পসচার দেখাচ্ছে এটা অশ্লীলতা। আচরণবাদী ফকিরদেরকে ‘বাউল’ নামে যে ব্রান্ড করা হলো… এটা কিন্তু ঠিক হয়নি ।
লেখক:
রফি হক, চিত্রশিল্পী, সম্পাদক, শিল্পপ্রভা
আরও পড়ুন
কেন লালনকে চাই