‘চিজ-কেক’ কা জাওয়াব ‘লাল রোটি’ সে! । সাব্বির খান

Comments

।। সাব্বির খান ।।

‘সুশীল’ শব্দটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নেতিবাচক শব্দ হিসেবে ব্যবহার হলেও সংক্ষেপে তা মূলত আওয়ামীবিরোধী বুদ্ধিজীবিদেরই বোঝানো হয়ে থাকে। বিগত প্রায় ১০ বছর সরকারবিরোধী যেকোন আন্দোলনে এই সুশীল সমাজকে দেখেছি অত্যন্ত সংঘবদ্ধ এবং সুপরিকল্পিতভাবে সরকারকে তুলোধুনো করতে এবং বেকায়দায় ফেলার অপচেষ্টায় লিপ্ত হতে। তথাকথিত এই সুশীলচক্রের ‘বাকশৈলী’ আমাকে বিস্মিত এবং বিমোহিত করেছে বার বার! সত্যিকার অর্থে এই সুশীলচক্রটিই রাজনীতির মাঠে অনুপস্থিত ‘জামায়াত-বিএনপি’ বা সরকারবিরোধী রাজনীতিকে সরব রেখেছেন দীর্ঘ দশটি বছর! তাদের বাচনশৈলী, যুক্তিতর্ক, সুদুর প্রসারী কূটকৌশল ছাড়াও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে যোগাযোগ এবং মিডিয়ার ব্যবহার ছিল এতটাই উচ্চ মার্গীয় যে, জাতি বিস্মিত হয়েছে বৈ-কি! সুশীলচক্রের কার্যকলাপগুলো সরাসরি মাঠের রাজনৈতিক নেতাদের মত না হলেও বিগত বছরগুলোতে দেখেছি, এদের মোকাবেলা করতে গিয়ে একাধিকবার ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতারা ছাড়াও স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকেও সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে, যা ক্ষেত্রবিশেষে সরকার এবং ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতার শেষ পর্যায়ে রয়েছে এবং পরবর্তী নির্বাচনও প্রায় সন্নিকটে। এই দীর্ঘ সময়ে দেশে তথাকথিত বিরোধীশিবিরের রাজনীতি থেমে থাকেনি। আক্ষরিক অর্থে মাঠের রাজনীতিতে বিরোধীশিবির অনুপস্থিত থাকলেও দীর্ঘ সময় ধরে মূল রাজনীতি পরিচালিত হয়েছে সরকারবিরোধী ঘরানার সুশীলচক্রের মাধ্যমে। যার মধ্যে নিকট অতীতের কোটাবিরোধী আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সিনহার ঘটনাগুলো স্মরণযোগ্য।

মাঠের রাজনীতির আচার-আচারণ মাঠের মত হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে সক্রিয় বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে সরকারবিরোধী সুশীল বুদ্ধিজীবিদের রাজনৈতিক আচারন এতটাই সুসংগঠিত এবং উচ্চমার্গীয় ছিল যে, তা শুনতেও যেমন ভাল লাগতো- তেমনই ছিল দৃষ্টিনন্দন-শৈলীতে পূর্ণ! অবিশ্বাস্য হলেও, সুশিল সমাজের ‘ড্রয়িংরুম-বাকপটুতা’ মানুষকে বিমোহিত করতে পেরেছিল বার বার এবং সাময়িকভাবে হলেও সাধারনের মতিভ্রম ঘটাতেও তারা যথেষ্ঠ সফল হতে পেরেছিল। বলতে দ্বিধা নেই, পেশাজীবি রাজনীতিবিদদের প্রতি সাধারন জনগণের একধরণের অনিহা সৃষ্টিতে কথিত সুশিল সমাজ তখন এতটাই তোড়জোড় ছিলেন, যা বিভিন্ন সময়ে খোলাচোখেই দেখা যেতো। নিঃসন্দেহে এবং একাধারে তা যেমন ছিল রাজনৈতিক নেতাদের চরম ব্যর্থতার বর্হিপ্রকাশ, তেমনই কথিত এই সুশিলদের প্রতিরোধ করার স্বাভাবিক যে দায়ভার সরকারপক্ষের বুদ্ধিজীবিদের কাঁধে বর্তনের কথা ছিল, তা পালনেও তাঁরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিলেন বললে অত্যুক্তি করা হবে না!

বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে খুব ধীর গতিতে হলেও অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে একটি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম, যার অন্তরালে কাজ করেছে এই সুশিলচক্রটি। কথিত আছে যে, এই চক্রটিকে পেছন থেকে আদর্শিক এবং অর্থনৈতিকভাবে ইন্দোন যুগিয়েছে জনবিচ্ছিন্ন দু’টি দল, জামায়াত ও বিএনপি, যা নবগঠিত রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের অবয়ব বা গঠনপ্রকৃতি দেখলেই বোঝা যায়। নৈতিকভাবে জনবিচ্ছিন্ন হলেও দলদু’টির আদর্শিক এবং অর্থনৈতিক খুটির জোর এতো শক্ত যে, ঠিক নির্বাচনের পূর্বে এরা নির্বিঘ্নে পূর্বপরিকল্পিত জোটটি বাঁধতে সক্ষম হয়েছেন। নির্বাচনের প্রাক্কালে ‘যুক্তফ্রন্ট’ নামের রাজনৈতিক মোর্চার ছায়াতলে যে দলগুলোকে আমরা দেখেছি, তাদের আচার-আচরণ ও কথাবার্তাকে বিশ্লেষণ করলে কারোরই দ্বিমত করার উপায় থাকবে না যে, তারা জামায়াত-বিএনপির ‘অগ্রবর্তী প্রক্সিদল’ হিসেবেই বিগত বছরগুলোতে কাজ করেছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে বিকল্পধারা বাংলাদেশ (বদরুদ্দোজা চৌধুরী), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (রব), কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ (কাদের সিদ্দিকী) ও নাগরিক ঐক্য (মাহমুদুর রহমান মান্না) -এ চারটি দল নিয়ে গঠিত হয়েছিল যে জোট, তাঁর মূল নেতৃত্বে ছিলেন বিএনপি সরকারের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরী। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি সুষ্ঠ ও অবাধ নির্বাচনের দাবিতে মূলত তৈরি হয়েছিল এই জোট। বি চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকী ও রব ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে অবশ্য ‘এনডিএফ’ নামে একটি জোট গঠন করেছিলেন। কিন্তু তারা তখন বিএনপির সাথে একই সুরে নির্বাচন বর্জন করে তাদের পরিচয়ের পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছিলেন।

২০১৮ সালের আগষ্ট-সেপ্টেম্বরে বি. চৌধুরী, ডঃ কামাল, আ স ম রব, মাহমুদুর রহমান মান্নাদের দ্বারা গঠিত যুক্তফ্রন্ট যে মূলত জামায়াত-বিএনপির ‘অগ্রবর্তী প্রক্সিদল’ ছিল, তা আরো পরিস্কার হয়েছিল সরকারের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখে, যদিও বিষয়টি তখন অতটা খোলাসা ছিলনা। নির্বাচনের পূর্বে জামায়াত-বিএনপি যদি সরাসরি রাজনৈতিক মাঠে থাকতো এবং তারা যা কিছু করতো বা বলতো, যুক্তফ্রন্ট সেই কাজগুলোই ‘অগ্রবর্তী দল’ হিসেবে করেছে বললে বাড়িয়ে বলা হবে না! পরবর্তীতে বিএনপি এবং জামায়াতের মূখপত্র ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন যখন যুক্তফ্রন্টে যোগ দিল, আমার “অগ্রবর্তী-প্রক্সিদলের’ তত্ত্বটাই পক্ষান্তরে সিদ্ধতা পেলো।

নির্বাচনের পূর্বে জামায়াতের নির্বাক সমর্থন ও অর্থনৈতিক সহযোগীতা নিয়ে বিএনপি যুক্তফ্রন্টে যোগ দেবে বলে অনেকের মত আমিও ধারনা করেছিলাম এবং পরবর্তীতে তা কার্যে পরিণত হতে দেখে আমি অবাক হইনি ঠিকই; তবে অবাক হয়েছিলাম বিকল্পধারার জোট ত্যাগ করা দেখে, যা অনেকের মত আমারও হিসেবের ভিতরে ছিলনা। বদরুদ্দোজা চৌধুরীর জোট ত্যাগের অন্যতম কারণ ছিল জামায়াত-সমর্থনকারী বিএনপির বিরোধীতা করা। অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের বিরোধীতা করার জন্য ড. কামালের নেতৃত্বাধীন ঐক্যজোট থেকে বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্প ধারাকে বের করে দিয়ে সেখানে বিএনপিকে জায়গা করে দেয়া হয়েছিল বললে একই কথা বলা হবে।

বদরুদ্দোজার তৈরি যুক্তফ্রন্ট থেকে বিকল্পধারাকে বের করে দেয়া এবং যুক্তফ্রন্টের নাম বদলে ‘ঐক্যজোট’ রাখাটাও এক ধরণের রাজনৈতিক মেরুকরণের ঈঙ্গিত বহন করে! বর্তমান সরকারের ‘মহাজোট’ শব্দের বিপরিতে জামায়াত-বিএনপির ‘ঐক্যজোট’ শব্দের নামটিই যে বেশি যৌক্তিক এবং প্রাসঙ্গিক, তা বলাই বাহুল্য এবং রাজনৈতিক পরিভাষায় তার শুদ্ধতা খুঁজে পাওয়াও যথেষ্ঠ সহজ বলেই আমার মনে হয়। যাইহোক, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। তবে বিকল্পধারাবিহীন ঐক্যজোটের অন্যান্য শরিকদের সাথে নির্বাচনী আসন এবং খরচ ভাগাভাগি নিয়ে জামায়াত-বিএনপিকে যে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

নির্বাচনী তফসিল এখনো ঘোষনা না হলেও তা যেকোন সময় তা হয়ে যাবে। আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনা সরকারের যে নিরশংকু জয় হবে, তা নিয়েও বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোন ধরণের দ্বিমত পোষণ করতে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এমনকি বিরোধী দলগুলোর আচরণেও সে বিষয়টি পরিস্কার। একাধারে দুইবার ক্ষমতায় থেকে আবারও তৃতীয়বারের মত ক্ষমতায় যাওয়ার একটা সুনির্দিষ্ট অর্থ নিশ্চয়ই আছে, যা বোধকরি কোন রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিকে বোঝাতে হবে না। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের রাজনীতির মেরুকরণ দুই ভাগে বিভক্ত; স্বাধীনতার ‘পক্ষ ও বিপক্ষ’ এবং ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তাঁর নেতৃত্বাধীন দলগুলো ছাড়াও বাম দলগুলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বলে পরিচিত। এর বিপরিতে জামায়াত-বিএনপি জোটভুক্ত যতগুলো দল আছে, তারা একবাক্যে স্বাধীনতার বিপক্ষ দল হিসেবে পরিচিত ও চিহ্নিত। বাংলাদেশের ভবিষ্যত রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে মেরুকরণের এই বিষয় দু’টিকে মাথায় যারা রাখবেন, তারাই রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দেবেন বলে আপাত দৃষ্টিতে বিবেচিত হচ্ছে। যুক্তফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে এসে ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরী সেই দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন বলেই আমার বিশ্বাস। নব্বই দশকে বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় ছাড়াও জেনারেল জিয়াউর রহমানের জীবদ্দশায় বদরুদ্দোজা চৌধুরীর একাত্তরবিরোধী যে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত ছিলেন, সে পাপ মোচনের শেষ সুযোগটি হয়ত তিনি হাতছাড়া করতে চাননি। তিনি জানেন, তার অনুপস্থিতিতে উত্তোরসুরী হিসেবে তারই ছেলে মাহি বি. চৌধুরীকে এদেশে রাজনীতি করতে হবে। সুতরাং সমীকরণকে বেশি জটিল না করে জামায়াতসঙ্গ ত্যাগ করার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার দেখানো ট্র্যাকেই মাহিকে উঠিয়ে দিয়ে গেলেন বললে খুব বেশি বাড়িয়ে হবে না। তিনি যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াত-বিএনপির বিরোধীতা করে এবং ড. কামালের নেতৃত্বাধীন জামায়াত-বিএনপির ‘ঐক্যজোট’ ত্যাগ করে মূলত এ জাতীর সাথে করা আজীবনের ‘পাপমোচন’ করেছেন বলে আমি মনে করি। যদিও সব পাপ তামাদি হয় না।

শুধু কি তাই! কামাল হোসেনের দাওয়াতে তার বাড়ির বন্ধ দরজা থেকে ফিরে এসে এই বয়ঃবৃদ্ধ রাজনীতিবিদ যে মাত্রায় অপমান হয়েছিলেন, তারও একটা সমূচিত দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে বদরুদ্দোজা চৌধুরী এক মূহুর্ত সময় নষ্ট করেননি। সংলাপ অনুষ্ঠানে ড. কামাল প্রায় ২২ রকমের খাবারের জন্য অনুরোধ করেছিলেন যার মধ্যে ‘চিজ-কেক’ ছিল অন্যতম এবং হাস্যকর তো বটেই! পাশাপাশি বদরুদ্দোজাকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, জবাবে তিনি সংলাপ অনুষ্ঠানে তার দলের জন্য খাঁটি বাংলাদেশী খাবার রাখতে অনুরোধ করলেন, যে তালিকায় উল্লেখযোগ্য ছিল ‘লাল আটার রুটি’। অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরী তার এই অভিজ্ঞতার আলোকেই কামাল হোসেনের অপমানের প্রতিশোধ নিলেন ‘লাল আটার রুটি’ দিয়ে। রাজনৈতিক মহলে আজ কান পাতলে শোনা যে, ‘চিজ-কেক’ কা জাওয়াব ‘লাল রোটি’ সে!

সাব্বির খান

 

লেখক পরিচিতি:
সাব্বির খান
রাজনৈতিক বিশ্লেষক, লেখক ও সাংবাদিক

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট